নিজস্ব প্রতিবেদন:
শান্তি, সহানুভূতি ও মানবকল্যাণের বার্তা নিয়ে গত শনিবার ও রবিবার শিলিগুড়ির হায়দরপাড়া বিদর্শন ধ্যান আশ্রমে অনুষ্ঠিত হলো ৪৫তম মহা কঠিন চীবর দান উৎসব। দু’দিনব্যাপী এই উৎসবকে ঘিরে আশ্রম প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে ওঠে ভক্ত, সন্ন্যাসী এবং বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপস্থিতিতে।

শনিবার বিকেলে শুরু হয় শিশুদের অঙ্কন প্রতিযোগিতা ও কুইজ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। শিশুদের অংশগ্রহণে আশ্রমে জমে ওঠে উৎসবমুখর পরিবেশ।
রবিবারের দিনটি শুরু হয় ভোর ছ’টায় ত্রিপিটকের পাঠের মাধ্যমে। সকাল নয়টায় উত্তোলন করা হয় বিশ্ব শান্তির বৌদ্ধ পতাকা, এরপর পঞ্চশীল পাঠ ও সংঘ দান অনুষ্ঠিত হয়। সকাল সাড়ে এগারোটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত চলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির— যেখানে রক্তদান, চোখের পরীক্ষা, দাঁতের পরীক্ষা ও রক্তে শর্করা পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল।
দুপুরে সন্ন্যাসীদের জন্য ভিক্ষু ভোজনের আয়োজন করা হয়। এরপর দুপুর বারোটায় শহরের মধ্য দিয়ে বের হয় কঠিন চীবর দান শোভাযাত্রা। দুপুরের পর আশ্রম প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় ধর্ম আলোচনা , যেখানে ভিক্ষুগণ গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও চীবর দানের তাৎপর্য নিয়ে বক্তব্য রাখেন।
সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠান। সন্ধ্যা পাঁচটায় প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও প্রার্থনার মাধ্যমে দিনটি শুরু হয়। এরপর বৌদ্ধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন স্থানীয় ও বাইরের শিল্পীরা। অনুষ্ঠানটি আরও মনোজ্ঞ করে তোলে বাগডোগরার ব্যাংডুবি থেকে আগত প্রতিভাবান শিল্পী ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সঞ্চিতা বড়ুয়া। সে গৌতম বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করে, পাশাপাশি বিহু, লোকসঙ্গীত ও জনপ্রিয় গায়ক জুবিন গর্গকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গান গেয়ে মুগ্ধ করে সকলকে।
এছাড়া শিশু শিল্পী কৃতিকা বড়ুয়া ও সায়নী বৈদ্য নৃত্য পরিবেশন করে দর্শকদের মন জয় করে। আবৃত্তি পরিবেশন করেন মঞ্জু বড়ুয়া।
রাত আটটায় অনুষ্ঠিত হয় প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। দিনশেষে আকাশ ভরে ওঠে “হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন”-এর আলোয়— যা শান্তি, ঐক্য ও মৈত্রীর বার্তা দেয় সকলকে।
আয়োজক কমিটির তরফে রাজু বড়ুয়া ওরফে খোকন ও চীবর দান উৎসব কমিটির সম্পাদক তন্ময় বড়ুয়া জানান, “প্রতিবছরের মতো এবছরও পূর্ণ নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে সমস্ত অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। ভক্তদের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণে এই উৎসব সফলভাবে পালিত হয়েছে।”
কঠিন চীবর দান বৌদ্ধদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বর্ষাবাস, বর্ষাকালে তিন মাসের সাধনা, শেষে যে নতুন বস্ত্র বা চীবর অর্থাৎ ভিক্ষুদের পরিধানযোগ্য কাপড়,গ্রহণ করেন, সেটিই কঠিন চীবর দান নামে পরিচিত। এই চীবর ভক্তরা সন্ন্যাসীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও দানের মানসিকতা থেকে নিজের হাতে তৈরি করে প্রদান করেন। “কঠিন” শওব্দটি এসেছে পালি শব্দ কঠিন থেকে, যার অর্থ শক্ত বা দৃঢ়— যা ভিক্ষুদের ধর্মাচরণ ও ধৈর্যের প্রতীক।
এই উৎসব বুদ্ধের দর্শনের মূলমন্ত্র— দান, শীল ও ভাবনার— প্রতিফলন। দানশীলতা ও মৈত্রীর মধ্য দিয়ে সমাজে শান্তি, ঐক্য ও সহানুভূতির বার্তা ছড়িয়ে দেয় এই চীবর দান উৎসব।
মানবতার আলো ছড়িয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে এই দুই দিন ধরে হায়দরপাড়া বিদর্শন ধ্যান আশ্রম হয়ে উঠেছিল এক আধ্যাত্মিক তীর্থক্ষেত্র। গৌতম বুদ্ধের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত এই উৎসব শুধু ধর্মীয় নয়, মানবকল্যাণ ও সহমর্মিতারও এক উজ্জ্বল প্রতীক।

