
শিল্পী পালিত ঃ আজ আমাদের আত্মকথা বিভাগে কবি ও লেখিকা শতরুপা চক্রবর্তীর কথা মেলে ধরা হচ্ছে—

মুখর আমি, মৌন কবি
(কাব্য জীবন )
***************
কবিতা আমায় ছুঁয়েছিল শৈশবের লাল ফ্রকের বয়েসে। ছোঁয়াচে রোগ লেগে গিয়েছিলো মননে। সেই থেকে কবিতা যাপন আমার। নতুন ডাইরির পাতা ভরা শুধু ছন্দের দোলা, শুধু শব্দের কারুকার্য। ভরে ওঠে বইয়ের পিছনের সাদা পাতা, খাতার পিছনের বেশ কটি পাতা.. কি করি আর, পড়তে বসলেই তারা আসে, ঘিরে রাখে, আচ্ছন্ন করে। তাদের রূপ না দিলে পড়ায় মন লাগে না।
প্রেম এসেছে নিঃশব্দে, কবিতা আসবেনা এমন বাঙালিনী আমি নই। প্রেম বিচ্ছেদও খুব দ্রুত হয়ে গেলো আকস্মিক। মনের স্বাভাবিক গতিতেই, কাব্য বন্যা ভেঙে দিচ্ছে মনের আগল। চলছে পরীক্ষা নিরীক্ষা ছন্দ নিয়ে, বিন্যাস নিয়ে। সে সব আর এখন সংরক্ষিত নেই।
জীবনানন্দীয় কাব্যিক আবেশ, রাবীন্দ্রিক আবেগ নজরুলের দৃপ্ত উচ্চারণ জীবনকে ভরিয়ে তুলেছে কানায় কানায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একেকটি উজ্জ্বল তারকা মনের আকাশে দীপ্যমান এখনো। জয় গোস্বামী থেকে শ্রীজাত – কবিতার বর্ণমালা শিখে চলি অবিরত।
সংসারের আবর্তে বাধা পড়ে হারিয়েছিলাম কবিতার সুখ। সংসার সমুদ্রে নাকানি চোবানি খাচ্ছি, একসময় আবিষ্কার করলাম, আমি এক লাইনও আর সৃষ্টি করতে পারিনা। অদ্ভুত এক শূন্যতা।
প্রায় দশ বছর পর, হঠাৎ ঘুম ভাঙলো কবিতার। রাতে ঘুম ভেঙে যেমন জোৎস্নার প্লাবন দেখি, তেমনই আশ্চর্য প্রত্যাবর্তন তার…. একরাশ আলো নিয়ে ফিরে এসেছে সে.. আমার কবিতা… ফিরেছে অভিমানী ছন্দ, ফিরেছে ভুলে যাওয়া পংক্তিরা।
এখন দিবারাত্র বুনে চলছি কবিতার নকশি কাঁথা। আর তাকে যেতে দেবো না। কবিতার নকশি কাঁথার ওমে জীবনের শীত কাটে, জরা কাটে। দিদিমনির চাকরি,সন্তানের দেখভাল, সংসারের হাজার একটা কাজের পরেও নিজের একান্ত ভালো থাকা কবিতার সাথে।
বয়েসের সাথে সাথে জীবন নদীতে পলি সঞ্চয় হয়, নদীহারায় স্রোত, বহমানতা থমকে আসে। কন্ঠের প্রতিবাদ কবিতায় আশ্রয় নেয়। উদ্যম যখন থিতিয়ে পড়ে, কবিতা তাকে আশ্রয় দেয়। স্বপ্নেরা ছুটি চায়,পোড় খাওয়া চোখে স্বপ্ন নয়, বাস্তব রাজত্ব করে । তবুও, রঙ্গীন কবিতায় বেঁচে থাকে সেই অমল স্বপ্নেরা। খুন্তি হাতা, ঝাড়ু ন্যাতার জীবনে কবিতা ফুটে ওঠে নতুন আঙ্গীকে… জীবন মুখী হয় কবিতার ভাব। রান্নার তেল মাখা কবিতার পংক্তি উড়ে চলে চা বাগিচার দিকে, কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্র শৃঙ্গ ডাকে তাকে। আমার সন্তানের হাসি হয়ে যায় রূপক, আমারই কবিতায় ফুটে ওঠে তা । আমার বৃদ্ধ পিতামাতার ললাটে আমার কবিতা চুম্বন এঁকে আসে। প্রণয় ক্লান্ত কবিতা আমার একলা অন্ধকার ঘরে দীর্ঘশ্বাস হয়। ঈশ্বর আসেন কবিতার ভক্তি অশ্রু ধারায়। এই তো আমার জীবন।
জীবন জুড়ে জেগে থাকে আমার অবশ্যম্ভাবী কবিতা যাপন। আমার আনন্দিত কবিতা উৎযাপন। শোক আমাকে ছোঁয় না, সুখ আমাকে বিহ্বল করে না, আমি যে শুধু কবিতার বর্ম অঙ্গে ধারণ করেছি।
বেঁচে থাকে জীবন আমার , তার পরতে পরতে মেখে থাকে কবিতা। মুখর ব্যক্তি আমি মৌন কবি। আবার, বাস্তবে নিজের দুঃখ সুখ লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করা আমার কবিতায় একমাত্র সম্পূর্ণ আত্ম প্রকাশও।
আসলে, কবিতার জীবনটা আমার আয়ত্তাধীন। আমারই খেয়াল খুশিতে গড়ে তোলা এক কবিতার পৃথিবীর আমিই বাসিন্দা। তাই বাস্তব পৃথিবীর কর্কশ অসুন্দর কঠিন রূপ পাল্টে নিতে চাই কবিতার জাদু স্পর্শে, যা কিছু সুন্দর তার প্রতিচ্ছবিও এঁকে যাই কবিতায়।
কবিতার সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছি, আমৃত্যু তাকে সঙ্গী করে চলতে চাই…, জানিনা কবিতা কথা রাখবে কিনা।
*********
কিছুই পারিনি জীবনে কবিতা ও না !
তবুও ধ্বনি জাগে রক্তে, হৃদয়ে ছন্দের হানা –
হে প্রেম !দিও কবিতার অলংকার-
নিঃশেষে ফুরিয়ে,দাঁড়িয়েছি এসে, খোলো দ্বার ll
✍️শতরূপা চক্রবর্তী
প্রধান নগর
শিলিগুড়ি