মাদার টেরিজার সেবামূলক কাজ পড়েই সমাজসেবাতে নুরুল হাসান

নিজস্ব প্রতিবেদন ঃ ছেলেবেলায় বেশ কষ্ট সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তিনি বড় হয়েছেন। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত মালদার প্রত্যন্ত গ্রামে তাকে হ্যারিকেনের আলোতেই পড়তে হয়েছে। আর স্কুলে যেতে হয়েছে অনেকটা ভাঙাচোরা রাস্তা পেরিয়ে। গ্রামে বহু মা-কে দেখেছেন অপুষ্টি বা রক্তাল্পতায় ভুগতে। সমস্যা-প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় তিনি মাঝেমধ্যেই মাদার টেরিজার জীবনকাহিনী এবং তার সেবামূলক কর্মকান্ড পড়ে উদ্বুদ্ধ হতেন।
তার বাবা মহম্মদ ইলিয়াস সামান্য প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক ছিলেন।বাবা তাকে বলতেন,বিদ্যাই বড় সম্পদ। আর সেসবকে পাথেয় করে লড়াই সংগ্রাম চালানোর সময় ভাবতেন, বড় হয়ে যে কাজই তিনি করেন না কেন,সমাজসেবা কখনোই ছাড়বেন না। সমাজের অসহায় মানুষ, গরিব শিশুদের পাশে সবসময় থাকবেন। ছোটবেলার সেসব ভাবনা বড় হয়ে ভুলে যাননি। মালদার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে জীবনের চলার পথে অনেক ঝড় জল টপকে আজ তিনি শিলিগুড়িতে বসে একদিকে বহুতল ইমারত তৈরি, জমি ও জামাকাপড়ের ব্যবসা,ফিল্ম তৈরির মাধ্যমে অনেক সম্পদের অধিকারী হলেও দুঃস্থ ফুটপাথ শিশু, গরিব মানুষদের সেবা থেকে নিজেকে কখনোই গুটিয়ে নেননি। সমাজসেবার কাজকে শক্ত ভাবে চালিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি করেছেন শিলিগুড়ি লিটারারি ফাউন্ডেশন। আর তার প্রধান কর্তা তিনি। নুরুল হাসান।
শিলিগুড়ি থেকে মালদা, সাহিত্য জগতেও তিনি এখন পরিচিত নাম। ইতিহাসে অনার্স নিয়ে এম এ পাশ করেছেন। এমনিতে ইটপাথরসিমেন্ট নিয়ে কাজ করলেও নিজে পাথরের মতো হয়ে যাননি। কারণ তার ভিতরে যে ছোট থেকে আর একটি জিনিস প্রবেশ করে আছে, তা হল একটা কবি মন। রয়েছে তার সাহিত্যের প্রতি অসীম অনুরাগ। ছোটো থেকেই তিনি কবিতা লেখেন। এটা তার নেশা। ছখানা বইও তার প্রকাশিত হয়েছে। আবার তার গবেষণাধর্মী মনও আছে। মালদার মুসলিম অধ্যুষিত শেরশাহবাদীয়া মুসলিম উপজাতির ওপর তার গবেষণা রয়েছে। রয়েছে এর ওপর দুখানা বই। একটি শেরশাহবাদীয়া -ভাষা- সমাজ ও সংস্কৃতি। অপরটি শেরশাহবাদীয়া প্রেমের গীত।বিয়ের সময় মেয়েরা নিজেরা এগান তৈরি করে,নিজেরাই আবার গায়।
নুরুলবাবু বলেন, সাহিত্য আসলে মনের খোরাক। এ এক নেশা। সেই নেশার টানে তিনি শুধু নিজে সাহিত্য চর্চা করে থেমে থাকেন না, প্রতি মাসে বসান সাহিত্য সভা। তাতে বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক যোগ দেন। বছরে একবার বড় আকারে সাহিত্য আসরও বসান তিনি। আর তার পুরো খরচই তিনি বহন করেন। চালু করেছেন হাসান সাহিত্য পুরস্কার।
তবে এসবের চেয়েও বড় কথা, তার সাহিত্য ভাবনা কাগজকলমে বা বইয়ের পাতায় থেমে থাকেনি। তার ছোটবেলার সংবেদনশীল মন বড় হয়ে যেন প্রাপ্ত বয়স্ক হয়েছে। রবিবার হলেই সবাই যখন এদিকওদিক আউটিং বা একটু আশেপাশে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ছোটে তখন তিনি চলে যান এনজেপি স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম শিশুদের দিকে। কোনও রবিবার তিনি ছোটেন আশপাশের চা বাগান বা বৃদ্ধাশ্রমে। তার সঙ্গে থাকে ডাক্তার এবং ওষুধ। শুরু হয় তার সেবামূলক কাজ। এভাবে সারা বছর বিভিন্নভাবে সেবামূলক কাজ করে চলেছে তাদের লিটারারি ফাউন্ডেশন।
এসবের বাইরে তিনি আবার ফিল্ম তৈরি করছেন।দুটি সিনেমা তার রিলিজ হয়েছে। আর একটি শীঘ্রই মুক্তি পেতে চলেছে। টালিগঞ্জেে তার হাসান ফিল্মের অফিসও রয়েছে। ফিল্মে তার লক্ষ্য,যত বেশি সম্ভব উত্তরবঙ্গের প্রতিভাদের সুযোগ করে দেওয়া। তার ফিল্মগুলোতে গজেন্দ্র চৌহান, আশিস বিদ্যার্থী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরা অভিনয় করেছেন।
মালদার অজপাড়াগাঁ রতুয়ার বড় ভালুকবাজার গ্রাম থেকে অনেক কষ্ট, লড়াই, সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তিনি উঠে এসেছেন। তার স্ত্রী জুলি হাসানও তার কাজে সবসময় উৎসাহ দিয়ে চলেছেন তাকে। নিজের ব্যাবসা থেকে অর্থ বাঁচিয়ে তার একটা অংশ দিয়ে সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চাকে উৎসাহ দিতে নুরুলবাবুর এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে নজির তৈরি করেছে উত্তরবঙ্গে।