করোনার এই দুর্যোগে অন্যরকম এক বন্দেমাতরম_মা

বাপি ঘোষ ঃ”আমার সেবা নিয়ে তোকে বেশি ভাবতে হবে না, তুই যেভাবে দেশের সেবা করে যাচ্ছিস সেভাবেই দেশ-সেবা করে যা।দেশ মায়ের সেবা মানেই জেনে রাখবি তোর মায়ের সেবা” —- এই পরামর্শ গুলো একজন মা তাঁর পুত্র সন্তানকে দিয়ে চলেছেন নিয়মিত। পুত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ডাঃ পুষ্পল চক্রবর্তী আর মা প্রতিভাময়ী সঙ্গীত শিল্পী অদিতি পি চক্রবর্তী। সদ্য প্রয়াত অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার প্রভাত চক্রবর্তীর স্ত্রী অদিতিদেবী। আগামী পনের আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের আগে দেখুন খবরের ঘন্টায় অন্যরকম এক দেশ প্রেমের গল্প যা হয়ত অনেক সিনেমার গল্পকেও হার মানাবে। বিশেষ প্রতিবেদন বাপি ঘোষের।
শিলিগুড়ি থানা থেকে ভক্তিনগর থানা, যারা পুরনো দিনের একটু খবর রাখেন, তাঁরা সকলেই একবাক্যেই জানেন প্রভাত চক্রবর্তীকে।২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি জলপাইগুড়িতে পুলিশের ডি এস পি হেড কোয়ার্টার হিসাবে অবসরগ্রহণ করেছিলেন। একজন সৎ এবং ভালো পুলিশ অফিসার হিসাবে তাঁর সুনাম রয়েছে। শুধু তাই নয়,মানুষ হিসাবেও তিনি বেশ উঁচু মনের ছিলেন। গত বছর অক্টোবর মাসে তিনি প্রথমে করোনা পজিটিভ হলেও পরে বাগডোগরা সেনা হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১১ অক্টোবর। ভারতীয় সেনাবাহিনী বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রভাতবাবুর দেহ দাহ করার কাজ করে সাহুডাঙি শ্মশানে। আর সেনাবাহিনীর নজরদারিতেই তাঁর স্ত্রী অদিতিদেবী মালদার গঙ্গাতে গিয়ে প্রভাতবাবুর চিতাভস্ম বিসর্জন দেন।কেননা প্রভাতবাবুর জন্ম হয়েছিল মালদাতে। একবছরও হয়নি, স্বামী চলে যাওয়ার যন্ত্রণা সবসময় বিদ্ধ করে চলেছে অদিতিদেবীকে। কন্যা সন্তান পামেলা চক্রবর্তী এইসময় শোকবিহ্বল মায়ের পাশে থেকে সবসময় সঙ্গ দিয়ে চলেছেন। পামেলার স্বামী ডাঃ অর্নব ব্যানার্জী জয়পুরে কর্মরত একজন প্রথম সারির করোনা যোদ্ধা-চিকিৎসক।এমবিবিএস পাশ করে এখন এনাসথেসিস্টের ওপর এম ডি পড়ছেন। পিতাকে হারানোর বেদনা বুকে রেখে এবং মা’কে সঙ্গ দেওয়ার সময় এখন শিলিগুড়ি থেকে অতিবাহিত করছেন পামেলা। গতবছরই ১১ মার্চ বিয়ে হয়েছে তাঁর ।আর ২৯ বছরের তরুন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ডাঃ পুষ্পল চক্রবর্তী প্রভাতবাবুর অসুস্থতার সময় মনিপুর থেকে শিলিগুড়ি ছুটে আসেন।বাবার পাশে থেকে সেবা করেন।কিন্তু শেষ রক্ষ হয়নি। প্রভাতবাবুর শেষ কাজ করে তিনি আবার কর্মস্থলে ফিরে যান। কিন্তু এই যন্ত্রণাময় সময়ে তিনি মায়ের পাশে থেকে আরও কিছু দিন মায়ের সেবা করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু না, মা অদিতিদেবী পুত্র সন্তানকে বলেন, ” তুই আগে দেশের সেবা কর। দেশ মাকে সেবা করলেই জেনে রাখবি তোর মায়ের সেবা করছিস।” এভাবেই পুত্র সন্তানকে দেশ সেবায় সবসময় উদ্বুদ্ধ করেন মা অদিতিদেবী। বাবা-মার উৎসাহেই ও এন জি সির কাজ থেকে ইস্তফা দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া ডাঃ পুষ্পল চক্রবর্তীর। করোনার এই সময় চিকিৎসক হিসাবে অসামান্য সেবা দেওয়ার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে দু-দুটি বিশেষ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। আবার সম্প্রতি আর্মি ট্রেনিংয়ের শ্যুটিংয়েও নিজের অসামান্য প্রতিভা প্রদর্শন করে প্রথম স্থান দখলের মাধ্যমে বাংলার মুখ উজ্জ্বল করেছেন এই বীর চিকিৎসক। আর এসবের নেপথ্যে রয়েছেন মা অদিতিদেবীর প্রতিভা। হ্যাঁ,ছোট থেকেই সুরের জাদুতে এক অন্যরকম প্রতিভা হিসাবে বিভিন্ন মহলে সমাদৃত নাম অদিতিদেবী।ছোট থেকেই তিনি কবিতা লেখেন। আবার নিজের লেখা গানে নিজে সুর দেন।রক্ত দান থেকে শুরু করে দেশ প্রেমের ওপর বিভিন্ন গান তাঁর কন্ঠে শুনে পুলিশ অফিসার প্রভাতবাবু পেতেন বাড়তি অক্সিজেন। পুলিশের চাকরিতে নানা টেনশন, পরিবারের সঙ্গে সময় না দিতে পারার যন্ত্রণা প্রভাতবাবু ভুলে যেতেন স্ত্রীর সৃজনে। একইভাবে পুত্রকেও দেশপ্রেমের ভাবনায় ছোট থেকেই উদ্বুদ্ধ করে তুলেছেন এক অন্যরকম মা অদিতিদেবী। স্বামী হারানোর অসহ্য যন্ত্রণা ভুলতে এখনও অদিতিদেবী আশ্রয় নিচ্ছেন কবিতাকলমকে।লিখে চলেছেন নানান কবিতা। সঙ্গে আবার স্বামীর মানবিক ধর্মের কাজে সুর মেলাতে অসহায় গরিব দুঃখীদেরও পাশে থাকছেন। স্বামী তাঁর সঙ্গে সশরীরে নেই কিন্তু আছেন শয়নে স্বপনে, মননে। বন্দেমাতরম এর সঙ্গে যা আজকের এই যুদ্ধে বড় প্রাসঙ্গিক, বড়ই ইতিবাচক ভাবনা —-