
শিল্পী পালিত ঃ আজকের আত্মকথায় কলকাতার মিলন পার্ক থেকে কমল সেনগুপ্ত লিখেছেন তাঁর বাজনার কথা—

আমার বাজনা ও আমি
~~~~~~~~~~~~~~
ছোটবেলা থেকেই সুর ও ছন্দের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ ছিল আমার । কুচবিহারে কেটেছে ছোটবেলা , কৈশোর পর্যন্ত । ছোটবেলায় রাসমেলা থেকে দড়ি বাঁধা গলায় ঝোলানো যায় এ’রকম ছোট ঢোল কিনে দিয়েছিলেন বাবা , বাজিয়ে বাজিয়ে সবার কান ঝালাপালা করে দিয়েছিলাম । কলকাতায় এন্টালির পানবাগান লেনে মামাবাড়িতে এলে ওখানকার কালীবাড়িতে ঢাক বাজানোর জন্য নিয়ে যেতেন ওখানকার কর্মকর্তারা । ৪/৬ টা ইঁট পেতে তার ওপর দাঁড়িয়ে ঢাক বাজাতাম ।বাবার সরকারি চাকরি , কলকাতায় স্থানান্তর হওয়ায় কলকাতায় চলে আসি সেই কিশোর বেলাতেই ।
একটু বড়ো হ’লে তবলা , ঢোলও বাজানোর চেষ্টা করেছি । এমনকি গানও গেয়ে ফেলেছি …..
এভাবেই সময়ের সাথে চলতে চলতে হাতে ম্যান্ডোলিন চলে এলো । দাদা কিনেছিলেন একটা ম্যান্ডোলিন , কিন্তু কখনো বাজিয়েছেন বলে মনে করতে পারিনা । মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ এর চাকরি নিয়ে শিলিগুড়ি গিয়েছিলেন আমার দাদা । সেখানে উনি একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন বাবুপাড়ায় । ঘটনাচক্রে আমি শিলিগুড়িতে ওনার কাছে যাই এবং ম্যান্ডোলিন যন্ত্রের সাথে পরিচয় ঘটে । শিলিগুড়িতেই আমার ম্যান্ডোলিনে হাতেখড়ি । যন্ত্রটা সম্বন্ধে দাদারও কোনো ধারণা ছিল না । যে ক’দিন ছিলাম সারাদিন ঐ যন্ত্রের সাথে গল্প করতাম , আমি আমার ভাষায় , ও ওর ভাষায় । সখ্যতা তৈরী হ’লো কিন্তু যন্ত্রের ভাষা জানা না থাকায় আত্মিক মিলন সম্ভব হ’লো না । তবুও যন্ত্র টুং টাং শব্দে কথা বলে যেত , আমিও পরম যত্নে ওকে আদর করতাম আমার দু’হাত দিয়ে । এ’ভাবেই শিশুর মুখে প্রথম কথা ফোটার মতো দু’একটা গানের কলি ফুটে উঠলো । আন্তরিক চেষ্টায় কতো কি হয় !!
ধীরে ধীরে আমার ম্যান্ডোলিন আধো আধো সুরে কথা বলতে শুরু করলো । ম্যান্ডোলিন কলকাতায় খুব একটা জনপ্রিয় বা প্রচলিত বাদ্যযন্ত্র ছিল না , তাই আমি যাই বাজাতাম বন্ধুরা উচ্ছসিত প্রশংসা করতো । আমিও অনুপ্রাণিত হয়ে বাড়িতে মশারীর নিচে রাত ১:৩০/২ টো পর্যন্ত নিজের মতো করে অনুশীলন করতাম , রোজ না হ’লেও প্রায়ই । যাতে কারো বিরক্তির কারণ না হই তাই খুব আস্তে বাজানোর চেষ্টা করতাম , এবং এভাবেই প্লেকট্রাম দিয়ে তারে আঘাত করে জোরে ও আস্তে বাজানোর কৌশল আয়ত্বে এসে গেল ।
একজন ম্যান্ডোলিন বাদক লালা সৌরভ কান্তি দে ( বাচ্চু ) এর সাথে পরিচয় হ’লো , বন্ধুত্ব হ’লো । তার কাছ থেকে শিখলাম কি করে ম্যান্ডোলিনকে সুরে বাঁধতে হয় । শিখলাম ম্যান্ডোলিন বাজানোর বিশেষ শৈলী । পরবর্তীতে অন্তরঙ্গতা আরও নিবিড় হ’লো । আমরা একসাথে অনেক অনুষ্ঠানও করেছি ।অনুষ্ঠান অনেকই করেছি নানা জায়গায় , কখনও কোনো শিল্পীর সঙ্গী হয়ে , কখনও অন্য শিল্পীদের (বাদ্যযন্ত্রী) সঙ্গে নিয়ে । সে’সব উল্লেখ করে এই লেখার অবয়ব আর বৃদ্ধি করছি না ।প্রথাগতভাবে নির্দিষ্ট কোনো গুরুর কাছে ম্যান্ডোলিন বা সঙ্গীতের কোনো শাখার পাঠ নেবার সুযোগ হয় নি আমার ( দুর্ভাগ্যবশতঃ) । তবে অনেক গুণীজনদের সান্নিধ্য পাবার সৌভাগ্য হয়েছে , তাদের কাছ থেকে শিখেছি অনেক । শেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি এখনও , এখনও শিখি ছোট বড়ো সবার থেকেই । তাই আমার অনেক শিক্ষাগুরু । সবার কথা এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয় । তাই আর আলাদা করে কারো নামোল্লেখ করলাম না । আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করছি তাঁদের সবার উদ্দেশ্যে ।
তবে বিশেষ দু’জনের কথা বলতেই হয় । প্রথমজন আমার বিশেষ বন্ধু শ্রী শোভনলাল মুখোপাধ্যায় , বেবী বলে ডাকি । বেবী কী-বোর্ড বাজায় , কী-বোর্ড প্লেয়ার হিসেবে আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে প্রায় । ওর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি , এবং অনুপ্রাণিত হয়েছি , বাজনায় মাধুর্য আনতে যা সাহায্য করেছে । দ্বিতীয় জন শ্রীমান অগ্নিভ রায়চৌধুরী । আমার ও আমাদের আদরের আবীর । আমার শ্যালিকা ও ভায়রাভাই এর একমাত্র সন্তান । তার জীবনের প্রথম বৃত্তির ( National scholarship ) টাকায় আমাকে একটি বিদেশী ম্যান্ডোলিন উপহার দিয়েছে , আমাকে উৎসাহ দেবার জন্য !! আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার !!
পরিশেষে যাদের কথা না লিখলে এ’লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে , তারা আমার পৃথিবী , আমার পরিবার । আমার একমাত্র সন্তান আমার ছেলে , ও আমাদের কন্যাসম বৌমা আমাকে সব সময়েই উৎসাহ যোগায় । আমার শ্যালিকা শ্রীমতি দীপাবলী রায়চৌধুরী ও ভায়রাভাই শ্রী আশিস রায়চৌধুরী সব সময়েই অনুপ্রাণিত করেন । এবং আমার স্ত্রী শ্রীমতি চিত্রাঙ্গদা সেনগুপ্ত আমার বাজনার ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী ও উৎসাহদাত্রী । তার সহযোগীতা ও অনুপ্রেরণা না থাকলে অনেক আগেই হয়তো স্তব্ধ হয়ে যেত আমার ম্যান্ডোলিন ।
নমস্কার । এতক্ষণ ধৈর্য্য ধরে পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ।
kamal
Kamal Sengupta
P-7 Milan Park
Kolkata – 700 084