ইন্ডিয়ান পারিয়া ডগ নিয়ে পড়ুন বাবলী রায় দেবের এই গুরুত্বপূর্ণ লেখা

বাবলী রায় দেবঃ‘জীবে প্রেম করে যেই জন,সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’। বহুশ্রুত স্বামী বিবেকানন্দের বাণী যথাযোগ্য সম্মান পেতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকারের পারীয়াপ্রীতি আইনে।রাস্তার কুকুর-বিড়ালকে ঢিল ছোঁড়া বা যে কোনো রকম নির্যাতনের বিরুদ্ধে ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা,এমনকি ৫ বছর পর্যন্ত জেলও হতে পারে বলে বিল পাশ হতে চলেছে।গত ষাট বছরের পুরনো আইন সংশোধন করে এই বিল প্রণয়নের অর্থ লালি-লালুর মতো অবলা পথসকুকুর-কুকুরীদের জীবনরক্ষার সঙ্গে পশুপ্রেমীদের স্বস্তি দান।এত দিন পর্যন্ত এদের ওপর নির্যাতনের শাস্তি হিসেবে ৫০ টাকা জরিমানা দিয়েই পাড় পেয়ে যেত ঘাতকরা।কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন আইনকে বলবৎ করার সঙ্গে সঙ্গে অবলাদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতনা এবং জনশিক্ষাও ভীষণভাবে দরকার।

গত দুবছরে লালি একটি বাচ্চাকেও বাঁচাতে পারেনি।কোনোটাকে গাড়ি চাপা দিয়ে গেছে,কয়েকটা অজ্ঞাত কারণে রক্ত বমি করে মারা গেছে।মানুষের নির্যতেনের সঙ্গে সঙ্গে মেটিং সিজনে মেয়ে হওয়ার জ্বালা পোয়াতে হয়েছে লালিকে।স্বজাতি পুরুষদের থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য পালিয়ে বেড়িয়েছে,স্বস্তির জন্য নিজেকে আড়াল করতে নির্বাক চোখে আশ্রয় চেয়েছে।
দ্রৌপদীর অভিশাপে অভিশিপ্ত লালু-লালিদের যত্রতত্র knot বাঁধতে দেখলেই ইট,পাথর,লোহার রড,বালতি বালতি গরম-ঠান্ডাজলের বর্ষণ সহ‍্য করতে হয়।সমস্ত নির্যাতন সহ‍্য কর‍ে লালি এবারও গর্ভধারণ করে।কনকনে ঠান্ডায় এক কোণে বসে লালি অনাগত দিনের অপেক্ষা করে।ওর লড়াইয়ে সঙ্গী হয়ে যখন ওকে খেতে দেই,

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।হয়তো ভাবে, দো-পায়াদের আচরণ এমন ভিন্ন ভিন্ন কেন? কেউ মারে কেউ খাওয়ায়!ওকে খাওয়াতে গিয়ে বেশ কয়েকবার জনরোষের মুখে পড়তে হয়েছে।’কুকুর ক্ষতিকর প্রাণী’,’কুকুরকে খাইয়ে আপনি সমাজের ক্ষতি করছেন’ উক্তির শিকার হয়ে অবলাদের স্বার্থে সাহায্য চেয়ে উপদেশ ছাড়া কিছুই জোটেনি।

৪ঠা ডিসেম্বরের রাত থেকে লালি বেপাত্তা হয়ে যায়।ত‍ন‍্য তন‍্য করে খুঁজে দুদিন পর কালভার্টের নীচ থেকে বাচ্চাদের কুঁইকুঁই আওয়াজ পাওয়া গেলেও লালি দেখা দেয় আরো তিনদিন।শুকনো শরীরে লেজ নাড়িয়ে সামনে দাঁড়ায় খাওয়ার জন্য।সাবধানী লালি কালভার্টের নীচে এমন জায়গায় বাচ্চাদের লুকিয়ে রাখে যেখানে যাওয়া অসাধ‍্য ছিল।খাওয়ারের জন্য ডাকলে বেড়িয়ে আসতো কিন্তু বাচ্চাদের বেড় করতো না।

তুমুল বৃষ্টির রাতে লোডশেডিংয়ের মধ্যে বাচ্চাদের বেড় করে আশ্রয়ের সন্ধানে লালিকে এদিক ওদিক দৌড়তে দেখে দৌড়ে যান আমার স্বামী।ঠান্ডায় সিঁটিয়ে থাকা পাঁচটি বাচ্চার মধ্যে ফেডেড পাপ্পিটার অবস্থা তখন মৃতপ্রায়।”এটাকে বাঁচাতে হবে।”প্রায় পচে যাওয়া বাচ্চাটিকে হাতে দিয়ে ওঙ্কারবাবু দৌড়লেন অন‍্যদের বাঁচাতে।ড্রেনের জলের স্রোতে ভেসে যাওয়া আরেকটি ভীত কম্পমান বাচ্চাকে হাতে ধরিয়ে আবার ছুটলেন।ঘরে রুম হিটার জ্বালিয়ে ততক্ষণে ওদের চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছে আমার পুত্রকন‍্যা।
দুর্যোগের রাতে লালিসহ তিনটি বাচ্চাকে শেডের নীচে রাখার ব‍্যাবস্থা করা হলেও দুদিনের মাথায় তাদের বাইরে বের করে দিতে হয় পারিপার্শ্বিক চাপে।ভীষন ঠান্ডায় খোলা আকাশের নীচে মায়ের পরশে দুগ্ধপোষ্য তিনটি শিশুর দুর্দশা দেখে তিনদিনের মধ্যে ওদের জন্য একটি কাঠের ঘর বানিয়ে আনেন আমার স্বামী মানুষটি।।ছেচল্লিশ দিনের কঠিন লড়াইয়ের পর নিজের ঘরে বাচ্চাদের নিয়ে শান্তির আস্তানা পায় সাহসী লালি। ধন্যবাদ রঞ্জনদাকে,তাঁর আনুকূল্য ছাড়া একাজ সম্ভব ছিলো না।বর্তমানে লালির ঠিকানা মার্স এপার্টমেন্ট।

ইন্দ্রের দূত সরমার সন্তান লালির মতো সারমেয়রা সব পাড়াতেই নির্যতেনের শিকার হয়।রোদ-জল, ঝড়-বৃষ্টিতে রাস্তায় রাস্তায় ওদের জীবন কাটে।অথচ মানুষের ভাষা বোঝার ক্ষমতা এবং মানুষের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষমতাই কুকুরকে তার বন্ধু রূপে পরিচিত দিয়েছে,তাদের এই ভাব আদানপ্রদান করার এই ক্ষমতাকে বলা হয় social cognition।মানুষের সঙ্গে কুকুরের বন্ধুত্ব ১৫,০০০ বছরের পুরনো।কুকুর বিশেষজ্ঞদের মতে অতীতের নেকড়ে বা নেকড়ে জাতীয় পশুরা মানুষের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করতে শুরু করলে কুকুরের পূর্বসূরিরা আমাদের পূর্বপুরুষদের পাশে পাশে থেকে তাদের উচ্ছিষ্ট খেতে শুরু করে,

নেকড়েদের হিংস্র আচরণ কমিয়ে পোষ মানতে শুরু করে যাকে বলে domestication hypothesis। সেই তত্ত্বের ভিত্তিতে বলা হয়,জোড় করে পোষ মানানোর থেকে কুকুর নিজে থেকেই পোষ মানতে পছন্দ করে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে,কুকুরকে যাঁরা ভয় পান, তাঁদের তুলনায় কুকুর যাঁরা ভালবাসেন, তাঁরা কামড় খেয়েছেন বেশী,তার পরেও তারা বহাল তবিয়তে আছেন এবং সখ্যতা বজায় রেখেছেন।গবেষনায় এটাও প্রকাশ পেয়েছে,কুকুরের সঙ্গে সখ্যতায় সামাজিকতা বৃদ্ধি পায়,সঙ্গে মানসিক চাপ কমে এবং শরীরমন চনমনে থাকে।

ভারতের পথে ঘাটে চলতে গিয়ে যেসব কুকুরদের দেখে ঘৃণায় চোখ ঘুরিয়ে নেওয়া হয় তাদের’ইন্ডিয়ান পারিয়া ডগ’ বলে।এরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান,খুব সহজে প্রশিক্ষণযোগ‍্য এবং মানুষের সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি বন্ধুত্ব করতে ভালোবাসে।জিনের ভ্যারিয়েশনের জন্য এদের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাও অনেক বেশী।সবচেয়ে বড়ো কথা ইন্ডিয়ান পারিয়া ডগকে পৃথিবীর সেরা গার্ড ডগ হিসেবে গণ‍্য করা হয়, সে প্রমাণ লালিও দিয়েছে।ব্র্যাডফোর্ডের বাসিন্দা ম্যারি এবং স্টিভ মাসক্রফ্ট আমাদের দেশীয় পারীয়াদের ভালোবেসে ভারতেই থেকে গেলেন, তৈরী করলেন ডগক্লিনিক অথচ আমরা এখনো আমাদের দেশীয় কুকুরদের ব্রাত‍‍্য বলে মনে করি,ঘরে স্থান দিতে দ্বিধা বোধ করি,অথচ মুখে বলি ‘সব প্রাণে ভগবান বিদ‍্যমান’।
মন মস্তিষ্কের বাঁধা পেড়িয়ে পাড়ার পারীয়াদের সুস্থ,

সুন্দর,স্বাভাবিক জীবন দিলে একদিকে যেমন ভূতঋণ পরিশোধ হয় তেমনি অন্তিমের যাত্রাপথ সুগম হয় কারণ কমবেশি এটা আমাদের সবারই জানা, স্বর্গারোহণের দুর্গম রাস্তায় যুধিষ্ঠিরের সঙ্গী হয়ে ধর্মরাজ ‘কুকুররূপে’ তাঁর পথ দেখিয়েছিলেন।