‘চেষ্টা করলে টাটা- আম্বানি না হওয়া গেলেও ভালো মানুষ হওয়া যায়’

নিজস্ব প্রতিবেদন, শিলিগুড়িঃশিলিগুড়ি থানার এক পুলিশ ইনস্পেকটর তাকে ফোন করে বললেন,তিন মাস বিশ্রামে যাচ্ছেন যান কিন্ত ফোনটা খোলা রাখবেন।আবার পরিবেশপ্রেমী শ্যামা চৌধুরী তার তিন মাস বিশ্রামে যাওয়ার খবর শুনে বললেন,তিন মাস সমাজসেবা থেকে ছুটিতে যাচ্ছেন যান কিন্তু আপনার এত বড় সাম্রাজ্য কে সামলাবে? দিনের পর দিন সমাজসেবা চালিয়ে আজ মানুষের কাছে এমন একটি জায়গায় যিনি পৌঁছে গিয়েছেন তিনি হলেন শিলিগুড়ির সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়।
মাত্র আঠারো-উনিশ বছর বয়স থেকে সমাজসেবা করা তার নেশা।এখন তার বয়স ৬১ পেরিয়েছে।এখনও ছাড়তে পারেননি সেই নেশা। প্রতিদিন সকালে শিলিগুড়ি হাসপাতাল ভিজিট করা তার নেশা।কোন রোগীর রক্ত চাই,কার ওষুধ নেই,কোন বুড়ো লোকটাকে স্ট্রেচার ধরে বেডে পৌঁছে দিতে হবে,তিনি আছেন।হাসপাতাল থেকে সিনি,বিভিন্ন থানায় যোগাযোগ– কোন শিশু হারিয়ে গেলো,কোন মেয়ে পাচারকারীর খপ্পরে পড়লো,কে রাস্তার ধারে পড়ে থাকলো,কার বাড়ির লোকের হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না–খবর পেলেই তিনি আছেন।গরিব,অসহায় মানুষ বিপদে পড়লেই তিনি আছেন। না,ভোট পাওয়ার স্বার্থ নেই,টাকা রোজগারের ব্যাপার নেই,তিনি আছেন।কবছর আগেরই ঘটনা,শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পড়েছিলেন এক বৃদ্ধা,নাম রমা হোড়।মুখ দিয়ে পোকা বের হচ্ছিল।পাশ দিয়ে সবাই মুখে রুমাল চাপা দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন।খবর পেয়েই সোমনাথবাবু তাকে টাউন স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে হাসপাতালে নিয়ে যান।তার মুখ থেকে বের হয় শতাধিক পোকা।স্টেশনে পড়ে থাকতে থাকতে মুখের মধ্যে বহু মাছি ডিম পাড়ে।সেই ডিম থেকে মুখ দিয়ে বের হতে থাকে পোকা।তাকে সুস্থ করে রাঙাপানির আপনাঘর বৃদ্ধাশ্রমে পৌছে দেন সোমনাথবাবু।মৃত্যু মুখে চলে যাওয়া অজানাঅচেনা সেই রমা হোড় আজ ভালো আছেন বৃদ্ধাশ্রমে। আবার ফাসিদেওয়া চট হাটের এক বৃদ্ধ বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসে উঠেছিলেন।বাসের ভিড়ের চাপে তিনি পথ হারিয়ে ফেলেন।অসুস্থ অবস্থায় কে বা কারা তাকে শিলিগুড়ি স্টেডিয়ামের সামনে ফেলে রেখে যায়।দুদিন ধরে তিনি রাস্তায় পড়ে থাকেন।জানা যায় না তার নাম ঠিকানা।খবর পেয়ে সোমনাথবাবু তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন।খোঁজ করতে থাকেন তার পরিবারের। ছমাস বাদে তার ঠিকানা পেয়ে বাড়ি পৌছে দেন। এভাবে শিলিগুড়ি ডাঙিপাড়ায় বিষ্ঠা মাখানো অবস্থায় পড়ে থাকা আর এক বৃদ্ধকে সুস্থ করে তিনি তার বাড়ি দার্জিলিং পৌছে দেন। এরকম বহু নজির আছে। আর এত স্বার্থবিহীন নজির আছে বলেই থানার পুলিশ ইনস্পেকটর তাকে বলেন,তিন মাস বিশ্রামে গেলেও ফোনটি খোলা রাখবেন।তার বড় মেয়ে অনন্যার মেয়ের বিয়েতে তাই আর্শীবাদ করার জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার সি এস লেপচা সহ আরও অনেকে।
বড় মেয়ে অনন্যা ও মেয়ে জামাই অরুনাভ দিল্লিতে আইনি পরামর্শদাতা হিসাবে কর্মরত।সেখানেই সোমনাথবাবু ১২ আগস্ট চলে যাচ্ছেন তিন মাসের বিশ্রামে।যদিও ফোনের নেট ওয়ার্কেও দিল্লি থেকে তার সমাজসেবা চলবে বলে সোমনাথবাবু জানিয়েছেন। তার স্ত্রী ব্রততী,ছোট মেয়ে অঙ্কনা সবাই সোমনাথবাবুকে এই সমাজসেবার কাজে সহযোগিতা করেন।তার স্ত্রী বলেন,এমন দিনও দেখেছি সকালবেলা ও ঘুম থেকে উঠে বলছে, আজ আর বাইরে বের হবো না,শরীর ভালো নেই।তারপর হঠাৎ কারও ফোন এলো,অমুক লোকটা অসুস্থ।হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।ফোন পাওয়া মাত্রই প্যান্টশার্ট পড়ে সে লোককে হাসপাতালে ভর্তি করতে তিনি ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
দিনের পর দিন এভাবে মানুষের সেবা করায় বিভিন্ন সংস্থা ও সংবাদমাধ্যম থেকে সোমনাথবাবু প্রচুর সংবর্ধনা পেয়েছেন। তার আশ্রমপাড়ার বাড়িতে সেসব সংবর্ধনা স্মারক,মেডেল সব শোভা পাচ্ছে।সোমনাথবাবু বলেন,চেষ্টা করলে আম্বানি- টাটা না হতে পারলেও ভালো মানুষ হওয়া যায়।আর ভালো মানুষ হলে মানুষের কাছ থেকেও ভালোবাসা পাওয়া যায়। আমি আর আমার পরিবার ভালো থাকুক এই ভাবনা নিয়ে চললে হবে না।কারন আমরা সবাই সামাজিক প্রানী।সমাজের কাছে আমাদের সকলের ঝন থেকে যায়।সেই ঝন শোধ করা দরকার সামাজিক কাজের মাধ্যমে।
সোমনাথবাবু মরনোত্তর দেহদান আন্দোলন,চোখ দান আন্দোলনে যুক্ত।তাছাড়া সেন্ট জনস,স্টুডেন্টস হেলথহোম,কিশোর বাহিনী,সৃজন সেনা,বৃহত্তর শিলিগুড়ি নাগরিক মঞ্চ, ওয়েস্টবেঙ্গল ভলান্টারি ব্লাড ডোনার্স ফোরাম সহ আরও বহু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।তার বাবা প্রয়াত পূর্নেন্দু চট্টোপাধ্যায়ও সমাজসেবী ছিলেন।তিনি তার চোখ দুটো দান করে গিয়েছেন।চারদিকে যখন স্বার্থের জন্য টানাটানি, নতুনদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম সমাজসেবার ভাবনা তখন সোমনাথবাবুরা তিন মাসের জন্য বিশ্রামে গেলেও থানার অফিসার বলেন,মোবাইলটা কিন্তু খোলা রাখবেন।