হার না মানার লড়াই, ২৫ বছর ধরে ঘর বন্দি হয়েও লেখালেখি চলছে এই সন্ন্যাসিনীর

বাপী ঘোষ ,শিলিগুড়িঃ তিনি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন একজন সন্ন্যাসিনী।পঁচিশ বছর ধরে তিনি কার্যত একটি আশ্রমের ঘরে বন্দি। তার চলাফেরা, বিছানায় শোওয়া ,বিছানা থেকে ওঠা এবং বাথ্রুমে যাওয়া তার কাছে বিরাট এক লড়াই। তার লড়াইয়ের গল্প অবশই অনুপ্রেরনার মতো বিষয়। ১৯৭৮ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলায় অনার্স নিয়ে তিনি এম এ পাশ করেন। পরে বি এড পাশ করেন। আর এর পরপরই তাকে ভয়ানক ব্যাধি রিওমেটয়েড আরথাইটিস গ্রাস করে। অর্থ সমস্যার কারনে সেভাবে চিকিৎসা হয় নি। ফলে ধীরে ধীরে সেই ভয়ানক রোগ তাকে কার্যত শয্যাশায়ী করে তোলে। আজ পঁচিশ বছর ধরে বন্দি জীবনের যন্ত্রণা কাটাতে তিনি তুলে নিয়েছেন কাগজ কলম। আর তা দিয়ে একের পর এক সৃষ্টি করে চলেছেন। ৯২ শতাংশ প্রতিবন্ধী হয়েও তিনি কলম নিয়ে লড়ছেন। একের পর এক রম্য রচনা এবং ছোট গল্প রচনা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তার সঙ্গে আছে প্রার্থনা এবং বিনে পয়সায় দুঃস্থ কিছু ছেলেমেয়েকে শিক্ষা প্রদান।
শিলিগুড়ি শহর থেকে মাটিগাড়া থানা অতিক্রম করে যেখানে হিমুলের কারখানা আছে, সেখান থেকে আরও চার কিলোমিটার ভিতরে আছে নবীনজোত গ্রাম। সেখানেই আছে শিবানন্দ বেদান্ত যোগাশ্রম। সেই আশ্রমের একটি ঘরে পঁচিশ বছর ধরে সন্ন্যাসিনীর বেশে ষাট বছর বয়স্কা মহিলা শিলা বিশ্বাসের লড়াই চলছে। পঁচিশ বছর ধরে তিনি সেখানে বিছানা বন্দি। খুব প্রয়োজন হলে সকলের সহযোগিতায় একটু হুইল চেয়ার ব্যবহার করেন। তার আশ্রমিক নাম প্রজ্ঞা চৈতন্য। ২০১২ সালে কলকাতা বইমেলায় তার ছোট গল্পের বই প্রকাশিত হয়, নাম অমৃতা। তারপর ডিব্রুগড় কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ক্ষিতীশ রায়ের সঙ্গে যৌথ ভাবে তার রম্য রচনার বই একের মধ্যে দুই প্রকাশিত হয়। আবার ২০১৬ সালে শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গ বই মেলায় একটি রম্য রচনার বইতে তার কয়েকটি রম্য রচনা প্রকাশিত হয়। বাস্তব জীবনের বিভিন্ন ঘটনা যেমন ফ্ল্যাট সংস্কৃতি, একান্নবর্তী পরিবার, মুল্যবোধ কমে যাওয়ার বিভিন্ন দিক তার লেখায় ফুটে উঠেছে। প্রতিদিন তিনি কিছু লেখেন। তবে একনাগাড়ে বেশিক্ষণ কিছু লিখতে পারেন না। ত্রিশ মিনিট ধরে কিছু লেখার পর একটু শুয়ে নিতে হয়। আবার একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার কলম হাতে তুলে নেওয়া। একনাগাড়ে ত্রিশ মিনিটের বেশি কিছু লিখলে হাতে যন্ত্রণা হয়। তার হাত ও পায়ের হাড় গুলো জয়েন্টে জয়েন্টে সব জমাট বেঁধে গিয়েছে। ফলে হাত পা নাড়তে ভয়ানক কষ্ট। বিছানা থেকে উঠতে হলে কাওকে ধরে তাকে তুলে দিতে হয়। বসে থাকা অবস্থা থেকে বিছানায় শুতে হলেও ভয়ানক যুদ্ধ করতে হয় তাকে। এই রকম যন্ত্রণার মধ্যেও সকলের অলক্ষ্যে তিনি লেখনীর মাধ্যমে একের পর এক গল্প ও রম্য রচনা তৈরি করে যাচ্ছেন। তার কারন মনের জোর।
একসময় তিনি অসমে থাকতেন। স্নাতক উত্তীর্ণ হয়েছেন পাণ্ডু কলেজ থেকে। তার বাবা চাকরি করতেন রেলে। পরে অসমে বিতারন বা অশান্তি শুরু হলে চলে আসেন উত্তরবঙ্গে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স নিয়ে এম এ পাশ করেন। আর এম এ পাশ করতেই হটাত তার শরীরে সেই ভয়ানক রোগ শুরু হয়। টাকার অভাবে এলোপ্যাথি চিকিৎসা সেভাবে না করিয়ে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শুরু করেন। কিন্তু তার রোগ আর সারে নি। রোগ তাকে দিনকে দিন পঙ্গু করে তোলে। একসময় তিনি তার মা-কে নিয়ে মাটিগাড়ার ঐ আশ্রমে জীবন উৎসর্গ করেন। সংসার ধর্ম না করে গেরুয়া বেশ ধারন করেন। তার কথায়, জীবনে ইচ্ছে ছিল শিক্ষিকা হয়ে সমাজের সেবা করার। কিন্তু তা আর হয় নি। এখন লেখালেখি করেই সমাজের সেবা করার চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে তার নিয়মিত লেখা প্রকাশিত হয়। শরীরে খুব যন্ত্রণা। তার মধ্যেও গ্রামের কিছু দুঃস্থ ছেলেমেয়েকে তিনি নিয়মিত শিক্ষা দান করে চলেছেন বিনা পারিশ্রমিকে। সরকারীভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় মাসে ৭৫০ টাকা ভাতা পান। আর্থিক সমস্যা তীব্র। তাকে দেখভাল করার জন্য একজন লোক রাখতে হয়। সেই লোকের বেতন দেওয়ার ব্যাপার আছে। ফলে আর্থিক সমস্যা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তাদের আশ্রমের গুরুদেব স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর জীবনী নিয়ে এর পর একটি বই লেখার কাজে হাত দিয়েছেন। প্রতিবন্ধীদের কষ্ট ও অবহেলা নিয়েও কিছু লিখতে চান। কিছু কিছু সংস্থা তার সংগ্রাম ও প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু তার চাই সরকারি সাহায্য, পরিস্কার করে বলেন তিনি। আন্তর্জাতিক বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সমিতির সম্পাদক সজল কুমার গুহ বলেছেন, শিলাদি প্রতিভাময়ী। তারা সেই গ্রামে গিয়ে শিলাদিকে প্রায়ই দেখে আসেন আর তাদের সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য করেন। কিন্তু তার জন্য ব্যাপক অর্থে সরকারি সাহায্য দরকার। আর প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তিনি গ্রামের মধ্যে আশ্রমে থেকে যেভাবে লড়াই করছেন তা একটি অনুসরন করার মতো বিষয় বইকি। তার বাবা মা অনেক দিন আগেই প্রয়াত হয়েছেন। তার আপনজন বলতে আশ্রমের অন্য সাধু ও সন্ন্যাসিনীরা। রাত বিরেতে তার বাথরুম যাওয়ার প্রয়োজন হলে মোবাইলে তাকে অন্যদের ফোন করে ডেকে আনতে হয়। সে এক ভয়ানক লড়াই।