
শিল্পী পালিত ঃ করোনা আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। আবার অনেক কিছু উপহারও দিয়েছে।আজকের আত্মকথায় অরুণজিৎ দত্তের লেখা পড়লেই জানা যাচ্ছে করোনার পরোক্ষ উপহার বিষয়ে —

আলোয় ফেরার সত্যিটা ll
✍️অরুণজিৎ দত্ত ll
আজ যে আমি লেখা দিয়ে কথা বলি, আর কণ্ঠ দিয়ে সুর ও স্বর সাধি তার হাতে খড়ি আমার মায়ের হাত ধরে ছোট্টবেলায় l পড়াশুনা, দুস্টুমি আর খেলাধুলার বাইরে গিয়ে আবৃত্তি, তবলা, আঁকা এগুলোও যে সময় কাটানোর আনমোল রসদ হতে পারে,ছোটোবেলায় তার স্বাদ ‘মা’ পাইয়ে দিয়েছিলেন l গোটা বছর মারধোর খেয়ে পরীক্ষায় প্রথম/দ্বিতীয়/ তৃতীয় হলে আদর মিলতো ঠিকই – কিন্তু পড়াশুনার বাইরে গিয়ে এই অতিরিক্ত বিষয়গুলোতে পারদর্শিতা অর্জনের সুবাদে ঘরে-বাইরে সবার কাছে সহজেই আমি খুব গুণী ছেলে বলে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলাম l তখন থেকেই আবৃত্তি কিভাবে যেন মিশে গেলো আমার রক্তে- মজ্জাতে, মনের আনন্দে l
ছোট্ট থেকেই সক্কলকে নকল করার ব্যারাম আমার ভিতরে মূকাভিনয় ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলেছিলো হাস্যকৌতুক পরিবেশনের মাধ্যমে lবিকেলে খেলা ফাঁকি দিয়ে পাড়ার বড়দের নাটকের মহড়া দেখতাম দরজায় উঁকি মেরে l তা দেখে-শুনে নাটকের সব চরিত্রের সংলাপ গুলো মুখস্ত হয়ে যেতো l বাড়ি ফিরে চলতো গোটা নাটকের সব চরিত্রের ভূমিকাতেই আমার একক পরিবেশন l
খেলার ধরণ পাল্টে গেছিলো শিশুমেলা, মণিমেলায় ভর্তির পরে l সেখানে খেলার ছলে শৃঙ্খলা, চেতনামূলক শিক্ষা পেয়েছিলাম ড্রিল,প্যারেড ব্রতচারী,কোরাস নাচ-গান, অভিনয় এসবের মাধ্যমে l
স্কুল জীবনেই আকাশবাণী রেডিওতে শিক্ষার্থীদের জন্যে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেলাম আমার স্কুলের তরফ থেকে l আজকাল পত্রিকা’য় কৃষ্ণনগর হাই স্কুলের নাম-বৃত্তান্ত সমেত বিশিষ্ট ছাত্র হিসাবে আমার ছবি বেড়োলো স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের সাথে l রাজভবনে গিয়ে তদানীন্তন রাজপাল শ্রী নুরুল হাসানের কাছ থেকে পেলাম সাম্মানিক মানপত্র স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বর্ক্তৃতা উপলক্ষে রাজ্য-স্কুল স্তরে দেওয়া আমার তাৎক্ষণিক বক্তৃতার শিরোপা হিসাবে l এভাবেই নানান সাফল্যের পুরস্কারে ভরেছিলো আমার ছেলেবেলা থেকে তরুণবেলা l আর আবৃত্তিকে ভালোবেসে কখন যেন আমি মনে-মনেই জুড়ে গেছিলাম কবিতার সাথে l সেই থেকেই কবিতা লেখার ভূত ভর করেছিল আমার মাথায় l রপ্ত করেছিলাম টুক-টাক লেখা-লিখির অভ্যেসটাও l সেগুলো প্রকাশিত হতো স্কুলের দেওয়াল পত্রিকায় l ছাপা অক্ষরে আমার লেখা প্রথম দেখি আমাদের স্কুল ম্যাগাজিনে,পরে কিছু লিটিল ম্যাগাজিনেও ll
সব কোথায় হারিয়ে গেলো যেন জীবনযুদ্ধে এসে l টানা পনেরো বছর বেসরকারি চাকরির চরকায় পাক খেতে খেতে রূপান্তরিত হলাম এক যন্ত্র মানবে – শুধুমাত্র উপার্জনের এক ATM মেশিনে I সক্কাল থেকে রাত তখন শুধুই ছুটছি বেসরকারি জীবিকার লক্ষ্য পূরণে আর নিজেকে গুছিয়ে তোলার মরিয়া প্রয়াসে I সংস্কৃতিচর্চা তখন ব্রাত্য আমার চেতনা- চিন্তনে I যতো দূরে সরেছি কবিতা-গান-নাটকের জগৎ থেকে ততো নিজের জীবনে নিজেই হয়েছি এক বিচ্ছিন্ন অচেনা দ্বীপ- মানুষ l
হঠাৎ মহামারী এলো বিশ্বজুড়ে- করোনা l বিগত এক যুগ ধরে অসহ্য আমাকে সহ্য করে আসা মানুষটা গৃহবন্দি অবস্থায় আমাকে দিয়ে ফেসবুকে কলম ধরালো এক রকম জোর করে l সঞ্চয়িতা খুলে নিজে আবৃত্তি করার ছলে আমাকে বইটা ধরিয়ে শ্রোতা সেজে বসে যেতো সামনে l বাড়ির ছোট্ট সদস্যটির আবদারে মোবাইলে রেকর্ড হোলো আমার আবৃত্তির প্রথম ভিডিও l
অনভ্যাসের কারণে তখন সে কি জড়তা আমার – জিভ আড়ষ্ট উচ্চারণে, আবেগের ঘাটতি হচ্ছে ভাব প্রকাশে,কি এক লজ্জা- সংকোচে গুটিয়ে যাচ্ছি ক্যামেরার সামনে এসে l হাজারো মানুষের সামনে কতো শত অনুষ্ঠানে অনায়াসে পারফর্ম করা মানুষটি -সেই আমিই ঠিক ঠাক করে একটা উপস্থাপনাকে দাঁড় করাতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছি l হাল ছাড়ছে না পাশের এই দুজন মানুষ l বেশ অনুভব করছিলাম মরচে ধরেছে আমার সংস্কৃতি-মনস্কতায় l
তবে যে ছাঁচে গড়ে ওঠে একবার ছেলেবেলার মন , তাতে ধুলো জমলেও একটু ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে নিলেই অনায়াসে পুনরায় তাকে উন্মোচিত করা যায় আগের রূপেই l
আমার মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্যে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ আমার পাশের মানুষটার আদা জল খেয়ে লেগে থাকার সুফল ফলতে লাগলো অল্প কিছুদিনেই l কথায় কথায় লেখা জুটতে শুরু করলো আমার মাথায়, কন্ঠে স্বর এলো l প্রকৃতি প্রেমী দুই বয়স্ক তরুণ জুটে গেলো l যাঁদের সাথে শুরু হোলো মহা-প্রকৃতি দর্শন l আমার অন্তরের প্রকৃতিও তাঁর সাথে মিলেমিশে একসা হোলো ছন্দে-সুরে lগুরু-কৃপায়, মায়ের আশীর্বাদে, শতরূপের- শতগুণের সঙ্গিনীর হাত ধরে আজ আমার এই আলোয় উত্তরণ ll
বাঘাযতীন কলোনী, প্রধাননগর, শিলিগুড়ি ll