
অর্পিতা দে সরকার, শিলিগুড়ি, খবরের ঘন্টা : শান্তিনিকেতন নিয়ে আজকের বিশেষ খবর হলো,শান্তিনিকেতন ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় অন্তর্ভুক্তির পথে।সম্প্রতি এই শান্তিনিকেতন ভ্রমণের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।

সম্প্রতি আমার ছোট মেয়ে একটি আন্তঃজেলা টেবল টেনিস প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য বোলপুর গিয়েছিল। তার খেলার সূত্রেই আমাদের পরিবার বোলপুর সফরে বেরিয়ে পড়ে। এটি শুধুই একটি খেলার সফর নয়, বরং শান্তিনিকেতনের হৃদয়স্পর্শী পরিবেশে কাটানো কিছু অসাধারণ দিনের স্মৃতি হয়ে রয়ে গেল।
আমরা সকালবেলায় কলকাতা থেকে ট্রেনে রওনা দিই। মেয়েটার মধ্যে প্রচণ্ড উত্তেজনা—প্রথম বড় প্রতিযোগিতা, নতুন শহর, নতুন অভিজ্ঞতা। বোলপুর স্টেশনে পৌঁছে হোটেলে উঠেই শুরু হয় প্রস্তুতি। পরদিন খেলা ছিল, তাই প্রথম দিনটা বেশি কোথাও ঘোরাঘুরি না করে শুধু শহরটা একটু চিনে নেওয়া আর হালকা হোটেলিং করেই কাটিয়ে দিলাম।
পরদিন সকাল থেকে প্রতিযোগিতা শুরু হল। বিভিন্ন জেলার ছেলেমেয়েরা অংশ নিচ্ছে, সব্বার মধ্যেই একটা স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার স্পিরিট। মেয়েটা একটু নার্ভাস থাকলেও ধীরে ধীরে স্বচ্ছন্দ হয়ে গেল। কোচের গাইডেন্সে এবং নিজের চেষ্টায় সে দারুণ খেলল—দুই রাউন্ড জিতেও গেল! ওর মুখে যে তৃপ্তির হাসি দেখেছিলাম, সেটা সত্যি অমূল্য।
খেলার ফাঁকে আমরা শান্তিনিকেতন ঘুরে দেখার প্ল্যান করলাম। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভবন, উপাসনা গৃহ—সবকিছুতেই যেন এক অনন্য শান্তি ও স্নিগ্ধতা মিশে আছে। বিশ্বকবির স্মৃতি যেন বাতাসে মিশে আছে; প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ইটপাথরে তাঁর ছোঁয়া।
বিশেষ করে রবীন্দ্রভবন জাদুঘর আমাদের মনে গভীর দাগ কেটেছিল। এটি শুধু একটি জাদুঘর নয়, বরং কবিগুরুর জীবন ও সৃষ্টির প্রতিচ্ছবি। সেখানে কবির ব্যবহৃত নানা জিনিস, যেমন তাঁর চশমা, কালি-কলম, পোশাক, চিঠিপত্র, এমনকি তাঁর শেষযাত্রার সময় ব্যবহৃত তক্তাও সংরক্ষিত রয়েছে। তাঁর লেখা চিঠি আর কবিতার পাণ্ডুলিপি দেখে মনে হল, যেন সেই সময়টাতেই ফিরে গেছি। বিশেষভাবে তাঁর আঁকা স্কেচগুলো আমাদের অবাক করেছিল—একজন মানুষ কত রকম শিল্পে দক্ষ হতে পারেন, তার নিদর্শন এই সংগ্রহশালা।
একটি ঘরে তাঁর লেখা গ্রন্থের বহু ভাষায় অনূদিত সংস্করণও রাখা আছে—যা তাঁর সাহিত্যিক গৌরবের আন্তর্জাতিক পরিসর তুলে ধরে। সেখানকার নিঃশব্দ পরিবেশে হেঁটে চলতে চলতে মনে হচ্ছিল, যেন কবি আজও আছেন, নিরবে সব দেখছেন, শুনছেন।
আমরা সোনাঝুরি হাটেও গিয়েছিলাম—বাউল গান, হস্তশিল্পের দোকান, আর একটানা সানাইয়ের সুর যেন এক স্বপ্নের জগতে নিয়ে যায়। মেয়েটা একটা ছোট খুদে তালপাখা কিনে ফেলল, আর একটা বাউল গায়কের সাথে ছবি তুলল।
এই সফর আমাদের জন্য শুধুই খেলার নয়, মনের খোরাকেরও অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছিল। শান্তিনিকেতনের পরিবেশ, মানুষের সরলতা, আর বোলপুরের আতিথেয়তা—সবকিছু মিলিয়ে মনে হল যেন আবার আসতে চাই এখানে, আর একটু সময় কাটাতে চাই এই শান্ত, শিল্প ও সংস্কৃতিতে ভরা শহরে।
এই যাত্রা আমাদের মনে দাগ কেটে গেল। মেয়ের খেলা ছিল উপলক্ষ্য, আর শান্তিনিকেতন ছিল উপহার—একটা যাত্রা, যা মনের গভীরে বহুদিন বেঁচে থাকবে।