
বাবলী রায়দেব(কলকাতা)ঃ জাগো,তুমি জাগো!!দ্বিপান্বিতা উৎসব সমাগত।জোর কদমে চলছে তার প্রস্তুতি।কোভিডকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দুর্গোৎসব পালিত হয়েছে অনাড়ম্বরে।মন মেতেছে মাতৃবন্দনায়।
প্রশ্ন আমার অন্যখানে..

মাতৃবন্দনা থেকে শুরু করে যে কোনো উৎসবের পুরোভাগে থাকেন পুরুষ।যে স্থানে মাতৃ প্রতিমাকে অলংকার সাজসজ্জে ভূষিত করে বন্দনা করা হয় সে স্থানে রক্তমাংসের মায়েদের উপস্থিতির হার এতো নগন্য কেনো? অথচ পুজো মন্ডপ থেকে শুরু করে শহরের আনাচে কানাচে, এ গলি ও গলির প্রান্তরে, রাস্তাজুড়ে আলোকসজ্জার মাঝে টাঙানো সুসজ্জিতা নারীর বড়ো বড়ো ফেস্টুন,পোস্টার কি প্রমাণ করে..নারী পণ্য?
শতবর্ষ প্রাচীন ভরত রায়গুনকর মহাশয়ের বানী..
‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’.. উক্তিটিতে কবি দেশভক্তির আগে জননী অর্থাৎ মা শব্দটিকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন।সমস্তরকম বাহ্যিক নৈরাশ্য এবং হতাশা থেকে জননী এবং জন্মভূমি দুটো শব্দই পরম মমতায় আমাদের আগলে রাখেন।যে দেশে আমাদের জন্ম,বেড়ে ওঠা,খেটে খাওয়া, যে দেশের জলহাওয়া গায়ে মেখে চলতে শেখা সে দেশকে পিছনে ফেলে পরবাসে পাড়ি দিতে হৃদয় কাঁপে না কিন্তু আমাদের!
ঘরের মায়ের ক্ষেত্রেও কথাটা কি সমভাবে প্রযোয্য নয়?
মা, সে যেমনই হোক…মূর্খ, মলিন, শীর্ণ, কঠিন,ব্যথিত, পালিত, কুন্ঠিত,বেশ্যা,ভিক্ষিরি,
দুখী দরিদ্র,রাজনন্দিনী কিংবা গর্ভধারিনী.. ঋতুভেদে মায়ের কোলেই তো শৈশব থেকে কৈশোরের দিনগুলো কাটে। মায়ের রক্ষাকবচে সুরক্ষিত থেকে জগত চেনা হয়ে গেলেই মায়ের অবদান ভুলে যাই কি করে ?
শাস্ত্র বলে মানুষের জীবন দেবঋণ,ঋষিঋণ,পিতৃঋণ, নৃ-ঋণ, ভূত ঋণে আবদ্ধ।মানুষ জীবনভরের কর্মযজ্ঞে এই পাঁচটি ঋণ শোধ করার সুযোগ পেলেও মাতৃ ঋণ শোধ করার ক্ষমতা কোনো কালেই অর্জন করতে পারে না অথচ ভক্তি গদগদ চিত্তে ঘরের মাকে নির্মমতার বেড়াজালে বন্দী রেখে প্রতিমার আড়ালে কি খোঁজে মানুষ?
নারী শব্দের আধার ‘মা’ আর ‘মা’ শব্দে না কি স্বর্গ বাস করে..সেই স্বর্গ আরোহণের সন্ধানে মাটির মূর্তি তৈরী করে নিয়মনীতি মেনে ঘটা করে দুর্গা প্রতিমা,লক্ষী প্রতিমা অথবা অন্য যে কোনো প্রতিমার পুজো করে আত্মতুষ্টি লাভ করতে গিয়ে ভুলে যাই প্রতিটা প্রতিমা শব্দে ‘মা’ বিদ্যমান।
প্রতিমাদের কেউ দূর্গতিনাশিনী,কেউ ধনদায়ী কেউ বা বিদ্যাদায়ী অথচ এ সবকিছুর সমাহার রক্তমাংসের মায়ের সম্মান-সমাদর এ সংসারে কতটুকু? প্রতি ঘরে ঘরেই যে মা’য়ের বাস..সেই মায়ের মনের খোঁজ রাখেন কজন ?
‘মা কি আ-র করে?’ সত্যিই তো, মা কি করে..?
তাচ্ছিল্যের আবরণে আবৃত ওই চারটি শব্দ বলে দেয়,
‘মা’ সংসারে চলাফেরা করা এক বস্তু বৈ তো কিছু নয়।
সমস্ত আহ্লাদ, আবেগ, মান অভিমান, আদর আব্দারের জায়গা মা অথচ মায়ের অস্তিত্ব… স্বামীসন্তান পরিবারের সেবা, রুচি অনুযায়ী সকলের পছন্দ মতো পঞ্চ পাকে খাদ্যান্ন পরিবেশন করা আর খাদ্যে এতোটুকু লবন তেলের হেরফের হলেই..’তুমি কিছু পারো না’ বলে দোষের ভাগী হওয়াতেই সীমাবদ্ধ।
চিরকাল ধরে এটাই তো মায়েদের নিয়তি।
পেট কেটে,যোনি চিড়ে যে সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানো হয়..সমস্ত শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে বড়ো করা হয়..মায়ের অধিকার নিয়ে সেই সন্তানকে শাষন করতে গেলে শুনতে হয়,’ যা বোঝো না সেটা নিয়ে বলতে এসো না’ অথবা ‘চিল্লিও না তো’!
অপমান করার হাজারো পন্থা অবলম্বন করে মায়ের মুখে পেড়েক ঠুকে জন্ম দেওয়ার মাশুল তুলে নেয় সন্তান।
‘মা’ নামে নারীকে ধন্য করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে সন্তান এগিয়ে যায় উত্থানের পথে আর মা’ নির্মম প্রতিদানের বদলে সন্তানের পথ চেয়ে ঈশ্বরের কাছে তার মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করে..’যেখানে যে আছো ভগবান,আমার সন্তানের তরে দিলাম দুর্বা ধান’।
বিষাক্ত নিম্নশ্রেণীর কীটপতঙ্গ মা-মাকড়সা বা মা-কাঁকড়াবিছাদের অবস্থা বোধহয় শ্রেষ্ঠজীব
মানুষ -মায়েদের থেকে অনেক বেশি স্বস্তিকর। জন্মের পর পুরো শরীরটাই ছেড়ে দেয় সন্তানদের স্বার্থে।
মায়ের শরীরের রস-মাংস খুবলে খেয়ে যখন চলতে শেখে তখন পড়ে থাকতে দেখে একটা খোলস। তাই হয়তো ওদের মধ্যে পুজোপার্বণের নামে ঢঙ করার চল নেই।
সত্যিই,আমরা সুদূরের পিয়াসী!
দূর থেকে আকাশের চাঁদ সত্যিই সুন্দর কিন্তু তার নাগাল পাওয়া সাধ্যের অতীত ..নইলে ঘরের মা’কে অভুক্ত রেখে ষোড়শ উপচারে মাটির প্রতিমায় ভোগ নিবেদন করি কি করে?
‘লুকাইব আমি সন্ধ্যার আঁধারে বাংলা মায়ের ক্রোড়ে।’ কবির বানী বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে যেন ভুলে যাই! ভুলে যাই মায়ের কোল,আঁচলের কথা..
দেশ কাল ভেদে ‘মা’ যে এক বিশাল বটবৃক্ষ সেটাও বোঝায় ইংরেজি শব্দ Mother !
m বাদ দিলে পড়ে থাকে other..আজকের অতিশিক্ষিত,অতি বোদ্ধা সন্তানরা এখন mother ভুলে other ব্যাপারেই বেশি ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে।বছরের শেষে ঢাক ঢোলের সমারোহে প্রতিমা দর্শন,বিসর্জনের মাধ্যমে পাপ ঘুচালেই তো এ জীবন ধন্য ..আর কি চাই? কি চূড়ান্ত অবক্ষয় গ্রাস করছে আমাদের মন মস্তিষ্ককে..কবে বুঝবে মানবসমাজ?
“মাতরং পিতরঞ্চৈব সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ দেবতাম” অর্থাৎ পিতা মাতা সাক্ষাৎ দেবতা। পিতা যদি পুরুষের আধার হয় তবে পুরুষের হাতেই নারীর এতো অবমাননা কেনো..
প্রকৃতির অঙ্গ নারী,শক্তির আধার নারী.. নারী অবলা নারী অসহায়..আগ বাড়িয়ে পুরুষ দায়িত্ব নিয়েছে তাকে রক্ষা করার। আসলেই কি তাই?
মাটি কোপালে রক্ত বের হয় না ঠিকই কিন্তু কেঁপে উঠলে কেউই আর আমরা স্থির থাকতে পারি না।পাপের ভারে ক্লান্ত প্রকৃতি প্রতিহিংসা নিতে ছাড়ে না।কোনো পরিস্থিতিতেই সে অস্বাভাবিকতা মেনে নিতে পারে না তার প্রমাণ,বর্তমান পরিস্থিতি।
উন্নয়নের আবিষ্কার একসময় পৃথিবীকে মুড়িয়ে দিয়েছিলো প্লাস্টিকের আবরণে,প্রতিদানে প্রকৃতি মানুষকে আপাদমস্তক প্লাস্টিকে মুড়িয়ে দিয়ে আজ তার শক্তির প্রমাণ দিয়েছে।
সাধে কি আর বলে..কালিমার মহিমা ভয়াবহ। ভয়াবহতার প্রসঙ্গ প্রথমেই আসে মহা কালীর বিধ্বংসীরূপের কথা..এলোকেশী বিবসনার কটিবন্ধনে কাটা হাতের মালা,গলায় মুন্ডমালিনী, একহাতে খড়গ, একহাতে অসুরের রক্ত ঝরা কাটা মাথা,এক হাতে অভয়মুদ্রা অপরহাতে বরদান..
সটান শুয়ে থাকা শিবের বুকের ওপরে দাঁড়িয়ে দেবীর হুঙ্কার ছাড়ার রূদ্র রূপ কি প্রমাণ করে..নারী অবলা ?
তবে কালীর প্রতি এতো ভক্তি প্রদর্শন কেনো?
ভয় থেকেই কি ভক্তি? সকলেই না কি শক্তের ভক্ত আর ভক্তিতেই শক্তি..সারাবছরই তাই মায়ের পুজো চলে সমারোহে।
একে কালো তার ওপর মেয়ে..মাও ভক্তের মন রেখে চলেন ..ডাকাত থেকে খুনি,ব্যবসায়ী থেকে মুনি সবাই মায়ের আশীর্বাদে ধন্য।
বিভিন্ন জায়গায় মা পূজিত হন ভিন্ন ভিন্ন নামে..
দক্ষিণকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্রীকালিকা, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালী, শ্মশানকালী,মহাকালী, কালকালী, কামকলাকালী, ধণকালী, সিদ্ধিকালী, চণ্ডিকালিকা,ছিন্নমস্তা,বগলামুখী ভবতারিণী, আনন্দময়ী, করুণাময়ী ব্রহ্মময়ী…আরো কতো কিই!পুজোপার্বণের বাজারে কালো মায়ের রেটিং তো আকাশ ছোঁয়া কিন্তু বিয়ের বাজারে কালো মেয়ের দর এতো নিম্নগামী কেনো? কোথায় যেনো আমরা নিজেদের সঙ্গেই নিজেরা একটু ছলনা করছি না?
কিছুদিন পরেই শক্তির আরাধনায় আমরা হৈ হৈ করে ময়দানে নেমে পড়বো । দুঃখ কষ্টের খরা কাটাতে মোমবাতি,প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকসজ্জায় মেতে উঠবো..আলোর রোশনাইয়ে অমাবস্যার নিকশ কালো রাতের আঁধার ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করবো কিন্তু কালিমাকে কি বিলুপ্ত করতে পারবো ?
শক্তির আরাধনায় ব্যস্ত মানুষ আমরা নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবাই মিলে অপেক্ষাকৃত দূর্বল, তা সে
নারী বা পুরুষ অথবা নিম্নশ্রেণীর জীবই হোক না কেন,তাদের আঘাত-অপদস্থ করে নিজের চরিত্রকে তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে যে আত্মতৃপ্তি লাভ করবো , সেটা কিসের পরিচয় বহন করবে?
দুটো মোমবাতি মিছিল,তিন মাথার মোরে গুটিকয়েক বক্তব্য রেখে মেতে উঠবো আবার নতুন ধ্বংসযজ্ঞে।কয়েকটা আহারে উহারে করে ভুলে যাবো আমাদের ঘরেও মা-বোন আছে!
বিশ্বসংসারের ভার সামলাতে গিয়ে নারী কখনো মাতা,কখনো বঁধু,কখনো ধাত্রী,কখনো দুহিতা হয়ে নিজেকে নিংড়ে দেয় সমাজ সংসারের কল্যানে।নিজের অস্তিত্বের কথা ভুলে হাজারো অপবাদে অলংকৃতা নারী পুরুষের পাশে থেকে নিরন্তর শক্তি জোগায়।
আকন্ঠ বিষপানে আচ্ছন্ন শিবকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য তারা মায়ের স্তন্যদান কি সেই নিদর্শনই স্থাপন করে না ?মহাকালের বুকে চেপে মা কালী আসছেন হিসেব নিতে। কালীতেই কাল তথা অন্তিমের অস্তিত্ব। ভূত চতুর্দশীর রাতও সেই বার্তাই দেয়..তাই হয়তো চোদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে, চোদ্দ শাকের জল ছিটিয়ে ভুত তাড়ানোর ধুম পড়ে যায়।
পুজো আসবে পুজো যাবে..দেবী কখনো দূর্গা,কখনো কালী,কখনো লক্ষ্মী, কখনো সরস্বতী হয়ে পৃথিবীর বুকে এসে পুজো নেবেন ..সবাইকে দেখবেন..
যাওয়ার আগে যাকে যাকে যা যা দেওয়ার, দিয়ে চলেও যাবেন।
আর আমরা নারী পুরুষ, ধনী দরিদ্র, কালো সাদা , উচ্চ নিম্ন..জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই হাত জোড় করে ভক্তি ভরে দেবীর কাছে বরাবরের মতো অনেক কিছু চাইবো কিন্তু মানুষের নৃশংস কোপের হাত থেকে পৃথিবী সমাজ সংসারকে রক্ষা করার অঙ্গীকার কি করবো ?
দূর্গা থেকে কালী..সবাই আমাদের ঘরে ঘরে। দূর্গা কালীর মধ্যে কোন দ্বন্দ্বের কথা আমার জানা নেই, কিন্তু ঘরে ঘরে সবার সাথে সবার যে দ্বন্দ্ব,সেটা যেদিন বন্ধ হবে…সেইদিনই হবে উৎসবের দিন!কন্যা সন্তানের মুখ দেখে যেদিন বাড়ির লোক মুখ না ঘুরিয়ে আশীর্বাদ দেবে ,সে দিনটা হবে উৎসবের দিন!
কালো মেয়েটা শশুরবাড়িতে বঁধুর সম্মানে সম্মানিত হয়ে যেদিন গর্ব অনুভব করবে সেদিনটা হবে উৎসবের দিন..
বাকী তো সব লোক দেখানো বাজে খরচ!!
(*লেখাটি ,কাউকে আঘাত করা বা কষ্ট দেওয়ার জন্য নয়, কিছু বাস্তবতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। অপরাধ নেবেন না।*)