ডঃ গৌরমোহন রায় ঃ নবতি বর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি

উমেশ শর্মা,জলপাইগুড়ি ঃ’জীবনের স্মৃতি জীবনের ইতিহাস নহে —–তাহা কোন এক অদৃশ্য চিত্রকরের স্বহস্তের রচনা। তাহাতে নানা জায়গায় যে নানা রঙ পড়িয়াছে, তাহা বাহিরের প্রতিবিম্ব নহে —- সে রঙ তাহার নিজের ভাণ্ডারের , সে রঙ তাহার নিজের রসে গুলিয়া দিতে হইয়াছে —- জীবনের বাহিরের দিকে ঘটনার ধারা চলিয়াছে, আর ভিতরের দিকে সঙ্গে সঙ্গে ছবি আঁকা চলিতেছে। দুয়ের মধ্যে যোগ আছে, অথচ দুই ঠিক এক নহে।’ —- রবীন্দ্রনাথ।
উত্তর ২৪ পরগণার বারাসতের বামনগাছি গাঁয়ের গৌরমোহন রায় দার্জিলিংয়ের লরেটো কলেজে পড়াবেন, শিলিগুড়ির সুকান্তপল্লীতে বাড়ির সামনের রাস্তার ‘অমিয়ভূষণ সরণি’ নামকরণ করবেন,আর ঐ বাড়ির নিভৃত ‘নীল নির্জন’ আবাসে বসে সৈয়দ মুজতবা আলী, তারাশঙ্কর, শরৎচন্দ্র, শিবরাম, ভানুভক্ত,অমিয়ভূষণ, অন্নদাশঙ্কর,প্রেমচন্দ্র, তসলিমা নাসরিন, উইলিয়াম জোন্স,মোক্ষমুলার,হরিচরণ, দেবব্রত বিশ্বাস,আর্যসভ্যতা,হরপ্পা সভ্যতা, রামায়ণ, মহাভারত চর্চার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া চর্চা করে ‘ঘর ও বাহির’কে এক করবেন—-তারাশঙ্কর আত্মজ সনৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে উত্তরবঙ্গের প্রাণসখা সুহাস তালুকদারের মতো হাজারো মানুষের সঙ্গে সখ্যতা অর্জন করবেন—তেমন মননে ও অন্তরের ক্ষরণের নানা রঙের আঁকা ছবি,অন্তর বাহিরের কোন যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া খুব একটা সহজসাধ্য কাজ নয়।তাই দু পাতায় তাঁকে ফ্রেমবন্দি করার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র।১৯৩২ থেকে ২০২২ পর্যন্ত নব্বই বছর অতিক্রান্তের দোরগড়ায় পৌঁছানো সাহিত্য জগতের বটবৃক্ষ সদৃশ গৌরতনু, দীর্ঘ গড়ন, ভদ্র- সুজন গৌরমোহন রায়কে যত দেখছি ততই আশ্চর্য হয়ে চলেছি।
তোর্ষাপারের অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘উরুণ্ডী’ গল্পের অন্যতম মুখ্যর চরিত্র পুলিন “উরুণ্ডী”শব্দটির অর্থ করেছিলেন বহির্গমন,যা ইংরেজিতে ‘একসোডার্স’ নামে বিখ্যাত। কোথাও বেরিয়ে পড়াই হল বহির্গমন। আমরা যারা সাহিত্য নিয়ে চর্চা করে স্বঘোষিত লেখক হতে চাই,তারা কিন্তু জেরুজালেম বাসীদের মতো পিতৃভূমির খোঁজে বেরিয়ে পড়ি না, মিশরের ফারাওয়ের অত্যাচারে ঐ দেশ থেকে পিতৃভূমির অন্বেষণে যাযাবর বা একসোডার্স হই না। কিন্তু কোন একটি ভাব বা বিষয়কে বেছে নিয়ে সাহিত্যের জগতে,আত্মানুসন্ধান বা ক্ষেত্রানুসন্ধানের জগতে ক্রমাগত ঘুরতে ঘুরতে সৃজনশীলতার বাহির ও অন্তরের ছবি এঁকে নতুন কিছু অনুসন্ধানের চেষ্টা করি। লেখক গৌরমোহন রায় তেমনই একজন বিশ্বপরিব্রাজক,মননে ভ্রামণিক, বিদগ্ধ চিন্তক ও প্রাজ্ঞ পরিবেশক।
হাওয়ায় পাওয়া নিয়ে কোনদিন দরবার করেননি, প্রচণ্ড আত্মাভিমানী গৌরমোহনবাবু এবং সে অর্থে তিনি সাহিত্যের কোন রত্ন নন, দেশের কোন ভূষণ নন। বৈষ্ণবীয় দীনতায় তিনি সকলের সঙ্গে মেশেন, পড়াশোনা করেন,ভাবেন ও লেখেন। তাঁর সংগ্রহে বিপুল দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থসম্ভার। একদিন ঐ সংগ্রহশালায় নিয়ে গিয়ে তিনি চোখের জল মুছতে মুছতে বলেছিলেন,–‘ উমেশ ভাই,বহু কষ্টে সংগৃহীত এই গ্রন্থভাণ্ডার আমি কাকে দিয়ে যাব? আমার তো দিন শেষ হওয়ার পথে।কেউ লাইব্রেরিতে একবারও ঢু মারে না। সবাই ব্যস্ত।’ সদাব্যস্ত কর্মজগতে বিদ্যা চর্চার জন্য আবেগ দরকার,সময় দরকার,গরজ দরকার—– এ যুগে ঐ গরজ বেশি লোকের নেই। বেশির ভাগ ভাগই ‘চলতি হাওয়ার পন্থী’ হয়ে সামান্য আয়াসে অসামান্য কিছু পেতে চান। মাটি খুঁড়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সোনার ফসল তোলার আগ্রহ অনেকেরই নেই।আর এই বয়সেও,ঐ পরিশ্রমের,নিবিড় পঠনের কাজই করে চলেছেন গৌরমোহনবাবু।
গৌরমোহনবাবুর প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর দিকে তাকালে বাংলা সাহিত্যে তাঁর মনীষা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যেতে পারে। প্রথম জীবনে ২৪ পরগণার ও হুগলির তিনটি হাই স্কুলে শিক্ষকতার পর তিনি রামকৃষ্ণ বেসিক ট্রেনিং কলেজে এবং দার্জিলিংয়ের শ্রী রামকৃষ্ণ প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনা কালে ভূগোল ও বাংলা শিক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে তিনটি পাঠ্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সেগুলো হলো — ১) ভূগোল শিক্ষাদান পদ্ধতি ২) ভূগোল শিক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি এবং ৩) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষণ পদ্ধতি। কিন্তু লরেটো কলেজে অধ্যাপনাকালে তিনি বাংলা গদ্য সাহিত্যের মননশীল গ্রন্থাদি রচনায় মনোনিবেশ করেন।তেমন কিছু অন্বেষার ফসল হলো –১) নেপালী আদি কবি ভানুভক্তের রামায়ণ গ্রন্থের গদ্যানুবাদ। ২) তারাশঙ্কর সাহিত্য সমীক্ষা ( দ্বিতীয় সংস্করণ)। ৩) তারাশঙ্কর জীবন ও সাধনা। ৪)চোমংলামার ছোট গল্প।৫) অমিয়ভূষণের রাজনগর ৬) সৈয়দ মুজতবা আলী ও অন্য লেখা ৭) উত্তরবঙ্গ ও অন্যান্য প্রবন্ধ ৮) নির্বাচিত প্রবন্ধ সংগ্রহ ৯) প্রবন্ধ নৈবেদ্য প্রভৃতি। এ গবেষণা গ্রন্থগুলির বেশিরভাগই তিনি ভালোবেসে বন্ধু সম্বোধন করে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। তারাশঙ্কর সম্পর্কে তাঁর ভ্রামণিক অনুসন্ধান ও নবতর তথ্য সংযোজন বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য উপহার। সিটি কলেজের ও মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজের ছাত্র, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর গৌরমোহন রায় ১৯৭৭ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষেত্র সমীক্ষা’ গবেষণা পত্রের জন্য পি এইচ ডি ডিগ্রী লাভ করেন।
এছাড়াও দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি দেশ, আনন্দবাজার, বর্তমান, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, কথাসাহিত্য সহ কমপক্ষে একশটি পত্র পত্রিকায় স্বদেশের ও বিদেশের শতাধিক মননশীল প্রবন্ধাদি লিখে নতুন নতুন তথ্যের সংযোজন ঘটিয়েছেন। স্বল্পজ্ঞাত ও অনালোচিত মৌলিক বিষয়ই তাঁর মুখ্য আকর্ষণ।অবসর জীবনে তাঁর কবিমন থেকে উৎসারিত হতো কবিতার ঝরনা ধারা। তেমনই তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘বিষণ্ণ বাতাসে একাকী।’ নীল নির্জনতার কবি প্রিয় নিকটজনদের হারিয়ে ও করোনা কালে মহামারীর হাহাকারে মর্মবেদনাকে রূপায়িত করেছেন কাব্যসুষমায়।
বিষয়বৈচিত্রে ও যুক্তিসংগত সবেদন প্রকৃতিতে তিনি বাংলা গদ্য সাহিত্যের বনেদি পরিসরকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। তাঁর প্রবন্ধ নৈবেদ্য’ র বিষয়সূচীর উল্লেখ এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। ভগবান বুদ্ধ ও সমকালীন ভারতবর্ষ,লিপির ইতিবৃত্ত : ইতিহাস ও ভাষাবিজ্ঞান ভিত্তিক সমীক্ষা, বিবেকানন্দ ও বিরজানন্দ : মায়াবতীর দিনগুলি,মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দানিলচুক,তিব্বতি অভিধান প্রণেতা এক বাঙালি পণ্ডিত,রূপ সনাতন গোস্বামী কি মুসলমান ছিলেন, মংপু মাঙপবী ও রবীন্দ্রনাথ,আফ্রিকাই কি সকল মানব ভাষার আদি উৎস? ইত্যাদি ১৯ টি গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ।
বাংলা সাহিত্যে বিশ্ব পরিব্রাজক ড. রায়ের আর একটি গ্রন্থের শিরোনাম ‘ মনীষী ম্যাক্সমুলার ইত্যাদি প্রবন্ধ’। এটির প্রকাশকাল ২০১৯ ।ঐ গ্রন্থের ১৯ টি নিবন্ধের বিষয়বস্তু হল ভারততত্ত্ববিদ ম্যাক্সমুলার, বিপ্লবী বিদেশিনী নিবেদিতা, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য,চার্বাক দর্শন,কাজী নজরুল ইসলামের বিবাহ প্রসঙ্গ,স্বামী প্রণবানন্দ ও ভারত সেবাশ্রম সংঘ, চিত্রশিল্পী তারাশঙ্কর, প্রাচীন ভারতের প্রত্নতত্ত্ব, সরস্বতী নদীকেন্দ্রিক প্রাচীন সভ্যতা,হরপ্পা সভ্যতা কি আর্যদের সৃষ্ট?, ইতিহাসের ছিন্নপত্রে দার্জিলিং, বিভূতিভূষণের কবি প্রকৃতি,সভ্যতা শ্লীলতা অশ্লীলতা এবং সাহিত্য,প্রাচ্য বিদ্যাচর্চা: উইলিয়াম জোন্স ও কেরী ইত্যাদি। প্রত্যেকটি তথ্যপূর্ণ, সাবলীল ও সুখপাঠ্য।
মেধাযুক্ত মননচর্চায় উত্তরবঙ্গে তাঁর সমকক্ষ নিশ্চয়ই হাতে গোণা। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধের দিকে বিহঙ্গ দৃষ্টি দিলে তা উপলব্ধি করা যেতে পারে। ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ পত্রিকায় প্রায় দু’ডজন প্রকাশিত নিবন্ধের অন্যতম তারাশঙ্করের জীবনে অনালোকিত অধ্যায়,পত্রাবলীতে বিবেকানন্দ, সৈয়দ মুজতবা আলী,নারীর বন্ধনমুক্তিতে আশাপূর্ণা দেবী, অন্তরঙ্গ বিভূতিভূষণ,শিবরামের হাস্যরস, বিশ্বমানব রবীন্দ্রনাথ —– কতো না বিচিত্র বিষয়।
‘ বর্তমান পত্রিকা’য় প্রকাশিত নিবন্ধের বিষয় সুদূর অতীতের মানুষ, নেপালী সাহিত্যে রামায়ণ, প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির উৎসসন্ধান ইত্যাদি গোটা দশেক নিবন্ধ।’ দৈনিক বসুমতী’ পত্রিকায় প্রায় সম পরিমাণ নিবন্ধের বিষয় হল অমিয়ভূষণের ছোটগল্প,অমিয়ভূষণের শেষ উপন্যাস,অমিয়ভূষণের উপর পাশ্চাত্য প্রভাব, অন্নদাশঙ্করের রত্ন ও শ্রীময়ী,প্রজ্ঞা ও প্রোজ্জ্বল
অন্নদাশঙ্কর ইত্যাদি। তাঁর দেড় শতাধিক প্রকাশিত নিবন্ধের প্রতিটিই গবেষণামূলক। তিনি লিখেছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকায়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকার মতো মহার্ঘ পত্রিকাতেও।
জীবনের অপরাহ্ণ বেলায় চিত্রকরের স্বহস্তে রচিত জীবনস্মৃতির প্রতি পাতায় উদ্বেগ আর ধূসরতা। জীবন পাত্রের কানায় কানায় ভরে উঠেছে বিশ্বসাহিত্যের কন্দর থেকে আহরিত রসসমুদ্র। তবুও নবতি বর্ষেও জ্ঞানপিপাসা অফুরন্ত। জীবন রসে ভরপুর মনন। বারাসতের বামনগাছি বাড়ির সংলগ্ন জমি জিরেত, গাছপালা, বাগান পুকুর, রেললাইন, পড়শী চাষজীবী পরিবারের হিন্দু মুসলমান, নিজের পরিবারের বৈষ্ণবীয় ধর্ম ও দর্শন তাঁর মানস ভিতকে পোক্ত করেছে উদারতায়,ন্যায় পরায়নতায়,অদম্য জ্ঞান পিপাসায়। মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামের হজরত একদিল শাহ্ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি।আজও ধর্ম বিশ্বাসে তিনি বৈষ্ণব এবং মানবতাবাদে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ে বিশ্বাসী।
মুসলিম প্রধান গ্রামের বিদ্যালয়ে পঠন কালে পাঁচ শ ছাত্রের মধ্যে চারজন মাত্র হিন্দু।মিলাদ শরীফের কোরআন ভিত্তিক আলোচনায় সমন্বয় ধর্মিতার পাঠ শুরু। বাড়িতে সংগৃহীত বৈষ্ণব পদাবলী,গীতা, শ্রীমদ্ভগবত, চৈতন্য চরিতামৃত,হজরত মুহাম্মদের জীবনী, কোরআন বাইবেল হাদীস উপনিষদের পাঠ এবং একই সঙ্গে এ বাড়িতে আউল বাউল সন্ন্যাসীদের আতিথ্য গ্রহণ তাঁর বুনিয়াদি ভিতকে সুদৃঢ় করে তুলেছিল। বরানগরের ভাগবত আচার্যের পাঠবাড়ি,মে বাড়িতে স্বয়ং মহাপ্রভু এসেছিলেন বলে শ্রুতি, ঐ বাড়ির সংস্পর্শে এসে তিনি বৈষ্ণবীয় দীনতা, নম্রতার পাঠ গ্রহণ করেছিলেন।
এমন সঞ্চয়কে পাথেয় করে আদর্শ শিক্ষক হবার লক্ষ্যে তিনি বাণীপুর শিক্ষক শিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বি টি পাশ করে শিক্ষকতার বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন।
তাই পরবর্তীকালে দার্জিলিং-এ অধ্যাপনা করতে এসে তিনি সম্যক পরিবেশে এসে সর্বজনপ্রিয় হয়ে মর্যাদার আসনটি লাভ করতে পেরেছিলেন। তার জানবার তীব্র কৌতূহলে তরাই ডুয়ার্সের স্থানীয় ভাষাও শিখেছিলেন এই ভাষা বিজ্ঞানী। ভাওয়াইয়া গান নিয়ে চর্চা ও ভানুভক্তের রামায়ণের গদ্যানুবাদ তারা স্বাক্ষর বহন করে।
এটা সম্ভব করে তুলেছিল বিভিন্ন মানুষের সান্নিধ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদগ্ধ পন্ডিত সমাজের সান্নিধ্যে তিনি দ্বিজ হতে পেরেছিলেন। কোন বিষয়ে তার কাছে তুচ্ছ ছিল না। তাই শিক্ষক-শিক্ষণ কেন্দ্রে শিক্ষাদান কালে তিনি ইউনেস্কোর ফ্রান্সের অফিস থেকে অনুমতি আদায় করে তাঁদের একটি ইংরেজী গ্রন্থের অনুবাদ করে শিক্ষার্থীদের জন্য রচনা করেছিলেন “ভূগোল শিক্ষাদান পদ্ধতি”। ১৯৬১ সালে বি.টি শিক্ষার্থীদের জন্য রচনা করেছিলেন মৌলিক গ্রন্থ “বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষণ পদ্ধতি”। ইংরেজি, নেপালি, বাংলা ভাষার একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধাবলী বিদ্ব্ৎ সমাজে সমাদৃত হয়েছে। বহু স্কুল-কলেজে, সভা-সমিতিতে তাঁর বক্তব্য শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে। তিনি সাবলীলভাবে ওই তিনটি ভাষায় বক্তৃতা দিতে পারেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানান যে, তিনি যাঁদের কাছে নেপালি শিখেছিলেন তারা হলেন__ কালিম্পংএর ডঃ পরশমনি প্রধান, বেসিক ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ মিঃ ঠাকুরি, লরেটো কলেজের অধ্যাপিকা ডক্টর কমলা সংকৃত্যায়ন,দার্জিলিং গভমেন্ট কলেজের লক্ষ্মীদেবী সুনদাস, বাবুলাল ছেত্রী, শ্রীরামকৃষ্ণ বি.এড কলেজের অধ্যক্ষ সূর্যবালা থাপা, সেন্ট রবার্টস হাই স্কুলের শিক্ষক ডঃ জগৎ ছেত্রী, কালিম্পং কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ ইয়ানজেন।, নেপালি সাহিত্যিক ইন্দ্র বাহাদুর রাই প্রমুখ। এই পাহাড়ী সমাজ ও জীবন সম্পর্কে তিনি স্মৃতিকথা লিখেছিলেন অধ্যাপক অজিতেশ ভট্টাচার্যের “মধুপর্ণী” পত্রিকায় এবং আত্মস্মৃতিতে “উত্তরবঙ্গ” গ্রন্থে।
তাঁকে তারাশঙ্কর সম্পর্কে গবেষণার কাজে সাহায্য করেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র সনৎকুমার বন্দোপাধ্যায়। “শনিবারের চিঠি”খ্যাত সজনীকান্ত দাশের পুত্র রঞ্জন কুমার দাশ, সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, “শতরূপা” সম্পাদক নির্মলকুমার খাঁ, দার্জিলিং গভঃ কলেজের অধ্যাপক ডক্টর সুবোধরঞ্জন রায় সহ অনেকেই।
১৯৯৪ সালে অধ্যাপনার জগৎ থেকে অবসর নেওয়ার পর ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি পরিপূর্ণভাবে লেখালেখির জগতে আত্মপ্রকাশ করেন। উত্তরবঙ্গের আত্মার আত্মীয় “উত্তরবঙ্গ সংবাদ” এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রয়াত সুহাস তালুকদারের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তাঁরই আহ্বানে তিনি “রামায়ণ ও মহাভারত পাঠের ভূমিকা” নামে একটি প্রচ্ছদ নিবন্ধ ঐ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। সেটাই শুরু। সুহাস তালুকদারের বহুমূল্যবান চিঠিপত্র গৌরমোহন বাবুর সংগ্রহে আছে বলে তিনি জানান।
কথা সাহিত্য,মধুপর্ণী,কিরাতভূমি, উত্তরের হাওয়া,মানসী, অঙ্গীকার, নবজন্ম, উত্তরধ্বনি প্রভৃতি বহু সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর লেখা মুদ্রিত হয়ে আছে। তিনি সংবর্ধিত হয়েছেন স্বদেশ ও বাংলাদেশের অসংখ্য সাহিত্য ও সামাজিক সংস্থা থেকে। বহু বইয়ের তিনি সমালোচনা প্রকাশ করেছিলেন। একজন চিন্তাশীল গবেষক, ভাষাতাত্ত্বিক ও প্রাবন্ধিক সেখানেই তাঁর পরিপূর্ণতা। অথচ তিনি রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে দীনতা প্রকাশ করে বলেন——
“মহত্তম মানুষের স্পর্শ হতে হইনি বঞ্চিত
তাঁদের অমৃতবাণী অন্তরেতে করেছে সঞ্চিত।”