যোগার সাহায্যে সন্তানকে মৃত্যু মুখ থেকে ফেরালেন মা

শিল্পী পালিত ঃ শিলিগুড়িতে যোগা প্রশিক্ষক হিসেবে একটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছেন অপুরানি উকিল। দেশবন্ধু পাড়ায় তার বাড়ি। অনেক ছেলেমেয়ে তার কাছে যোগা শেখে।আবার সংস্কৃতি চর্চাতেও তার নাম রয়েছে। কিন্তু কিভাবে তিনি যোগাকে পেশা হিসাবে নিলেন তা শুনুন তার নিজের মুখ থেকেই। একজন মা তার সন্তানকে মৃত্যু মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে যোগার সাহায্য নিলেন যেভাবে তা একটি ইতিবাচক ভাবনাই বইকি।

—–আমার ছোট ছেলে “স্বর্ণীল ভৌমিক “জন্ম থেকে লিভারে সিস্ট নিয়ে জন্মায়।এই রোগটা ছিলো এমনই ভয়ানক। কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রায় কিছুই ছিলোনা।ওকে যথেষ্ট যত্ন নেওয়া সত্বেও ওর শারীরিক উন্নতি আশানুরূপ না হওয়াতে আর শরীরের সাথে পেটের সামঞ্জস্যতা(পেট কিছুটা বড়ো) না থাকায় অনেকটা কৌতুহলবশত হয়েই ছুটে যাই ডাক্তার এর কাছে।তখন ওর বয়স মাত্র এক বছর। কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকায় ডাক্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে, কম করে বারে বারে খাওয়ানোর পরামর্শ দেন।আমার মনে হয়,সন্তানের জন্য একজন মা ই হলো সবচেয়ে বড়ো ডাক্তার।আমি তখন জোর করে ডাক্তারকে বলি আলট্রাসাউন্ড করাতে। আর তার জেরে তিন তিন খানা সিস্ট ধরা পড়ে। সার্জন এর কাছে নিয়ে গেলে তিনি দ্রুত অপারেশন এর পরামর্শ দেন।তিনি বলেন,বাচ্চাটি পড়ে গেলে এই সিস্ট ফেটে যেতে পারে আর তা হলে শিশুটির মৃত্যুও হতে পারে।তখন একটা পথদুর্ঘটনায় আমার পা মচকে যায়, একমাস বেড রেস্ট। অন্যদিকে ছেলের এই অবস্থা। তখন আমি বাংলাদেশ, আমার বাবার ওখানে ছিলাম।নিজের পায়ের এই অবস্থার জন্য আর ভারতে এসে চিকিৎসা করানোর শারীরিক অবস্থা ছিলো না
সন্তানে। বাধ্য হয়ে ঢাকাতেই অপারেশন করানোর সিদ্বান্ত নিই। অনেক ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসায় একবছর ছয়মাসের শিশুটি ও আমরা নানা ভোগান্তির পর চোদ্দদিন নার্সিংহোমে কাটিয়ে বাড়ি আসি।দুই মাস পর আবারো ওর পেট অস্বাভাবিক লাগাতে ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি আমাকে মানসিক চিকিৎসক দেখাতে বলে তিরস্কার করেন।পাশাপাশি পরিবারের পক্ষ থেকেও জোটে নানান সমালোচনা ।মায়ের মন,তাই লুকিয়ে আবার অন্য ডাক্তারের স্মরনাপন্ন হই।তখন আবার আলট্রাসাউন্ড এ ধরা পরে সিস্ট ব্যাক।দুই বছরের এই শিশুকে নিয়ে কোলকাতার বিভিন্ন হাসপাতাল, নার্সিং হোম ঘুরেও সমাধানের পথ খুঁজে পাইনি।কেউ বলেন,এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে,কেউ বলেন,সমস্যা তো নেই।বাচ্চা তো ঠিকই আছে।কিছু সমস্যা হলে নিয়ে আসবেন।অনেক জায়গায় ছোটাছুটি করেছি।একজন বললেন, লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে, অনেক খরচা।তখন প্রায় ৫০ লাখ।অসম্ভব, আর্থিক সংগতি নেই। আমি আশাহত।ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধীরে ধীরে তার জীবন প্রদীপ নিভতে দেখছি।একটু একটু করে ছেলে আমার নিঃশেষ আর নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। ৮৫%লিভার কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।সারা শরীর জুড়ে একটা বিশাল পেট। মৃত্যুর হাতছানি।পাগলপ্রায় অবস্থা আমার,অসহায় পরিবার।প্রথম সন্তান ৬ বছরের, হতবাক।এমতাবস্থায় আমার স্বামী খবর পায় হায়দরাবাদে লন্ডন এর একজন চিকিৎসক প্রায় বিনামূল্যে লিভার ট্রান্সফার করাচ্ছেন।গভীর অমানিশায় একটা আশার বিন্দু জ্বলে উঠল। ফোনে খবরাখবর করে,আর ইন্টারনেট ঘেটে বিশদে জেনে সিদ্বান্ত নিই শেষ একটি চেষ্টার।
আমার লিভার এর অংশ দেবো ছেলেকে।যদিওবা পরে দিতে হয়নি।৮ ঘন্টার অপারেশন। আড়াই বছর বয়স তখন ওর।
৮৫%লিভার বাদ দেওয়া হলো।২৪ দিন হাসপাতালে থাকার পর ফিরে এলাম। খুব খুশি ছিলাম, হয়তো ছেলে আমার ভালো হয়ে গেছে।কিন্তু তার এক বছরের মাথায় ছেলের আবার প্রচন্ড পেট ব্যথা, বমি। আবার হাসপাতা, আবার অপারেশন। তার ছয় মাস পর আবার একই অবস্থা, পেট ব্যথা, বমি। ডাক্তারি ভাষায় ইনটেস্টিনাল অবস্ট্রাকশন। আবার হায়দ্রাবাদ এবং সেখানে লেক্ট্রস্কপি।তিন বছরের মধ্যে চার চারটা অপারেশন। প্রতিবছরই তিন থেকে চারবার নার্সিংহোম। ডাক্তার বলেছিলেন,বমি শুরু হয়ে গেলে নার্সিংহোমে ভর্তি করতে। আমার দুর্ভাগ্য, রাত দুটো তিনটায়ই ওর বমি শুরু হতো তখন রাস্তাঘাট থাকত ফাঁকা। স্কুটির সাথে ছেলেকে ওড়না দিয়ে বেঁধে নার্সিং হোমে দৌড়াতাম। অনেকবার পাথরে ঠুকেও নার্সিংহোমের কর্মীদের ঘুম ভাঙিয়েছি।স্বামী বাইরে চাকরি করতো, তাই বড় ছেলেকে একা ঘরে তালা দিয়ে রেখে যেতাম, তখন তার বয়স ৭। হঠাৎ করে সমস্যা হতো বলে, রাতবিরেতে কাউকে রেখে যেতে পারতাম না। তারপর শেষমেষ যোগার শ্মরণাপন্ন হই। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, যোগা শুরু করার পর ওর অনেক উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। এখন ও কলেজে পড়ে। ভালো আছে। আপনারা ওর জন্য আশীর্বাদ করবেন। যোগার উপকারিতা অবর্ণনীয়। তাই প্রশিক্ষণ নিয়ে যোগাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছি। যোগাতে বহু রোগ নির্মূল হয়ে যায়। নিয়মিত যোগ চর্চা শরীর ও মন ভালো রাখে। বহু কঠিন ব্যাধি দূর হয়ে যায় যোগার সাহায্যে। আমার ছেলেতো মৃত্যু মুখ থেকে ফিরে এখন অনেক ভালো। যোগার জেরে আর আগের মতো চিকিৎসকদের পিছনে ছুটতে হয় না।