স্টেশন প্ল্যাটফর্মের আলোয় পড়াশোনা সন্তানদের ,এক অন্য মায়ের লড়াই

নিজস্ব প্রতিবেদন, শিলিগুড়িঃ ৮ ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বিভিন্ন স্থানে মহিলাদের গুরুত্ব ও নারী স্বাধীনতার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু শিলিগুড়ি জংশন স্টেশন লাগোয়া এক বস্তির সংগ্রামী মা মালতি রায়কে নিয়ে কি কোথাও আলোচনা হবে? আসুন একটু জেনে নিই সেই মায়ের সংগ্রামের কথা।
একসময় শিলিগুড়ি জংশন ষ্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে রাত কাটাতেন মালতিদেবী। পড়াশোনা তিনি জানেন না। হঠাৎই তার স্বামী তাকে ফেলে নিখোঁজ হয়ে যায়। তারপরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন কষ্ট করে হলেও ছেলেদের স্কুলে পাঠাবেন। আর সেই ভাবনা থেকেই তিনি ভিক্ষাবৃত্তি যেমন শুরু করেন তেমনই রাস্তাঘাটের ডাস্টবিনে যেখানেই কাগজ, পুরনো কাচের শিশি বোতল দেখেন সেগুলো কুড়িয়ে এনে বিক্রি করা শুরু করেন। আর তা দিয়ে কোনমতে দুটো ভাত আর ছেলেদের পড়াশোনার প্রয়াস চালিয়ে যান। যদিও তার মনে আক্ষেপ, টাকার অভাবে ছেলেদুটোর প্রাইভেট টিউটর দিতে পারেন না।
বড় ছেলের নাম মনোজ রায়। ও পড়ে কবি সুকান্ত বিদ্যালয় এর সপ্তম শ্রেণীতে। আর ছোট ছেলের নাম সনোজ রায়। ও পড়ে তৃতীয় শ্রেণীতে। একসময় প্লাটফর্মে থাকতে থাকতে তথাকথিত শিক্ষিত বাবুদের মুখ ঝামটা হজম করতে হয়েছে। শেষমেষ স্টেশনের পাশে বস্তির মধ্যে ছোট্ট একটি ঘর তিনি নিয়েছেন মাসিক ৭০০ টাকা ভাড়ায় । যদিও সে ঘরে কোন আলো নেই। রাতে ঘুমনোর জন্য কয় খন্ড বাসের টুকরো দিয়ে নড়বড়ে চৌকি তৈরি করা হয়েছে। আর সেই চৌকিতে ঘুমোতে হয় মা ও সন্তানদের।কোনও বাথরুম বা শৌচালয় নেই। তাই সকাল হলেই মালতিদেবী বাথরুম করার জন্য চলে যান জংশন ষ্টেশনের টয়লেটে। সেখানে স্নানও সেরে নেন। একই অবস্থা তার দুই সন্তানের। কিন্তু দিনের বেলা সন্তানেরা সূর্যের আলোয় ঘরে বসে তো পড়াশোনা করতে পারে কিন্তু রাতে? ঘরে তো আলো নেই। মনোজসনোজতো পড়তে চায়। তাই ওরা সন্ধে হলেই চলে যায় স্টেশনের প্লাটফর্মে। সেখানে আছে তাদের পাতানো এক দিদিমা। ভিক্ষা করে সন্ধ্যেবেলায় দিদিমা প্লাটফর্মে আসেন। দিদিমা যেখানে থাকেন সেই প্লাটফর্মে বেশ রেলের আলো জ্বল জ্বল করে। আর প্লাটফর্মে বসে সেই রেলের আলোতেই রাত নটা পর্যন্ত পড়াশোনায় মনোযোগী হয় ওরা। তারপর বাড়ি গিয়ে খাবার খেয়ে অন্ধকার ঘুটঘুটে ঘরে ঘুমিয়ে পড়া। এভাবেই চলছে তাদের বড় হওয়ার লড়াই। আর তাদের মা মালতিদেবী তাদেরকে দিনরাত স্কুলে পাঠানোর জন্য কখনো ভিক্ষা, কখনো ডাস্টবিনের কাগজ বোতল কুড়িয়ে যাওয়ার অন্য সংগ্রামে মেতে থাকছেন। এ এক অন্য মায়ের কাহিনী।