সব্জি বিক্রেতা এবং রিকশা চালক থেকে দেশের অন্যতম ক্রীড়া শিল্পোদ্যোগীী খোকন ভট্টাচার্য

নিজস্ব প্রতিবেদন,শিলিগুড়িঃ তার বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। কিন্তু প্রচণ্ড কষ্টে এক সময় তাদের দিন কেটেছে। টাকার অভাবে কলেজের ইউনিফর্ম ফুল প্যান্ট কিনতে পারেননি বলে কলেজে পড়াশোনা হয়নি। প্রাইভেট টিউশনির মাত্র 70 টাকা দিয়ে আদার ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। সেই আদার ব্যবসার সঙ্গে আদা জল খেয়ে লড়াই চালিয়ে আজ দেশের অন্যতম ক্রীড়া শিল্পোদ্যোগী তিনি। শিল্প বাণিজ্যের জন্য এখন অনায়াসেই এক কোটি টাকার ঝুঁকি নিতে পারেন শিলিগুড়ি শ্রীলাল মার্কেটের এই শিল্পোদ্যোগী। শুধু শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই নয়, একজন বিশিষ্ট সমাজসেবী হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে উঠেছেন তিনি।
পুরো নাম খোকন ভট্টাচার্য। তার বাবার নাম দ্বিজেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তার বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। জন্ম 1958 সালের 13 ই মার্চ। মূলত পরিবারের অভাবের জন্যই জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে তাকে বহু কাজ করতে হয়েছে। একসময় টিউশনির 70 টাকা দিয়ে তিনি আদার ব্যবসা করার জন্য একদিন পাহাড়ের গরুবাথান হাটে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে 60 টাকা দিয়ে কিনে আনেন ছাগল। সেই ছাগল পরদিন মাটিগাড়া হাটে 200 টাকায় বিক্রি করে 140 টাকা লাভ করেন। এভাবে জীবন সংগ্রামের লড়াইয়ে তিনি শিলিগুড়ি শহরে কখনো রিক্সা চালিয়েছেন, কখনো দুধ বিক্রি করেছেন, কখনোবা ডিম বিক্রি করেছেন। আবার বিধান মার্কেটে এক সময় তাকে সবজি বিক্রি করতেও দেখা গিয়েছে। এসবের মধ্যেও তিনি সত্তরের দশকে খেলাধুলা চালিয়েছেন, ভালো ফুটবল খেলতে পারতেন। খেলার প্রতি তার একটি দুর্বলতা ছিল। এভাবেই এক সময় তার এক কাকা মাত্র 125 টাকা মাসিক বেতনে তাকে বিধান মার্কেট এর 1 ক্রীড়া সামগ্রীর দোকানে চাকরির বন্দোবস্ত করে দেন। সেটা 1978 সাল। সেই ক্রীড়া সামগ্রী বিক্রি করতে করতেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তার যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। এরপর তিনি একদিন ভাবেন চাকরি করব কেন, নিজে কিছু করব আর সেই ভাবনা থেকে মাত্র সাত হাজার টাকা সংগ্রহ করে তিনি নেমে পড়েন ক্রীড়া সামগ্রী বিক্রি করার ব্যবসায়। সেটা ছিল 1981 সালের 15 আগস্ট। শুরু হয়েছিল শিলিগুড়ি স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রি। পরবর্তীতে স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রি থেকে তার বিশেষ ক্রীড়া সামগ্রীর তৈরীর কারখানা SILCO শুরু হয়। 1994 সালে পাঞ্জাবের জলন্ধরে শুরু হয় তাদের শিল্প কারখানা। প্রথমে ক্রিকেট ব্যাট তৈরি, পরবর্তীতে ফুটবল, ভলিবল, ট্রাকসুট এবং বিভিন্ন রকমের খেলাধুলার জুতো। আজ পাঞ্জাব ছাড়াও কেরালা, কলকাতা সহ অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছে খোকনবাবুর তৈরি করা সিলকো ব্র্যান্ডের বিভিন্ন ক্রীড়া সামগ্রী। খোকনবাবু চাইছেন, পাঞ্জাবের সেই কারখানার একটি মূল ইউনিট শিলিগুড়িতে স্থানান্তর করা আর তার এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তার হাত শক্ত করে চলেছেন তার একমাত্র পুত্র সন্তান গৌরব ভট্টাচার্য। এম বি এ পাশ করে বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল গৌরবের। কিন্তু বিদেশে না গিয়ে বাবার সঙ্গে শিল্পকারখানাতে মন দিয়েছেন গৌরব। এখন তারা জার্মানিতেও তাদের ক্রীড়া সামগ্রী পাঠানোর প্রয়াস শুরু করেছেন। খোকনবাবু জানাচ্ছেন, কোনও বেকার যুবক ক্ষুদ্র শিল্প কারখানা করতে চাইলে তার কাছে 50000 বা 1 লক্ষ টাকা নিয়ে গেলে তিনি কারখানা তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় যা যা পরামর্শ দেওয়া দরকার সব রকম সহায়তা করতে রাজি।তবে শিল্প কারখানা তৈরি বা স্বনির্ভরতার মানসিকতা ছেলেমেয়েদের মধ্যে তৈরি করতে হবে বাবামাকে। খোকনবাবুর স্ত্রী শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য এই শিল্প কারখানা তৈরিতে খোকনবাবুর সঙ্গে সহায়তা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। খোকনবাবু আরো জানাচ্ছেন, কর্মসংস্থান তৈরীর লক্ষ্যে তিনি এই শিল্প কারখানা খুলেছেন। এখন প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে তার কারখানা থেকে বহু পরিবার চলছে। শুধু মানুষকে কাজ দেওয়াই নয়, দুঃস্থ প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের সহযোগিতা করা, প্রতিবন্ধীদের সহায়তা করা এবং আরো অনেক রকম সামাজিক কাজ তিনি করে চলেছেন। তার বাবার স্বাধীনতা সংগ্রাম বা দেশসেবার ভাবনা তাকে আজও উদ্বুদ্ধ করে চলেছে। আর সেই কাজ করতে করতেই তিনি উত্তরবঙ্গে শিল্পোদ্যোগী এবং সমাজসেবী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে উঠেছেন যা বহু বেকার যুবক যুবতির কাছে এক অনুসরণ করার মত জ্বলন্ত উদাহরণ। বাংলায় যখন শিল্প হয় না বলে একটা প্রচার হয় তখন খোকনবাবুরা কিন্তু একটি আলাদা মাত্রার উদাহরণ হতেই পারেন।