লোক গান নিয়ে মেতে আছেন হৈমন্তী রায় পাটোয়ারী

শিল্পী পালিতঃ আজ লোকসঙ্গীত শিল্পী হৈমন্তী রায় পাটোয়ারীর কথা মেলে ধরা হলো —-আমার নাম হৈমন্তী রায় পাটোয়ারী। কুচবিহার জেলার হলদিবাড়ি মহকুমার দেওয়ানগঞ্জের বাগানবাড়িতে আমার জন্ম। বাবার নাম মানবেন্দ্র রায় পাটোয়ারী, মায়ের নাম পদ্মা রায় পাটোয়ারী। আমার বাবা খুব ভাল তবলা বাজান। জ্যেঠামশায় ও জ্যেঠিমা ভাল গান গাইতেন। আমার আড়াই ,তিন বছর বয়স কালে আমার কথার স্বরের বিশেষত্ব দেখে বর্তমানে স্বর্গীয় বিভূতি ভূষন মোদক বাবার কাছে আমাকে গানের জগতে প্রবেশ করানো ও সম্ভাবনাময়তার কথা বলেন। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় বিভূতিবাবুর কাছে আমার ক্লাসিক গানের প্রথম তালিম শুরু হয়। অন্যান্য গানও শেখাতেন তিনি। মা বাবার সাথে আমাদের বাড়ির গুরুদেব স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী দেবের সংঘে ভজন, ব্রহ্ম সংগীত গান গাইতাম।এর সাথে জলপাইগুড়ির শচীন দেব বর্মনের কাছে পাঁচ বছর ক্লাসিকে চণ্ডীগর ঘরানার বিশারদ ডিগ্রী অর্জন করি। হলদিবাড়ির রাজু প্রধানের কাছে রবীন্দ্র সংগীত, নজরুলগীতি,আধুনিক গানের তালিম নিই চার বছর। এই সময়েই ব্লক স্তরে ভাওয়াইয়া সংগীত প্রতিযোগিতায় আমাকে অংশ গ্রহনের জন্য তৈরী করার প্রস্তাব দেন বাবার কাছে আমার সংগীত জীবনের প্রথম শিক্ষাগুরু ঁবিভূতি ভূষণ মোদক, আমি জ্যেঠু বলেই ডাকি।ভাওয়াইয়া সংগীতে এই ভাবেই প্রবেশ করে একের পর এক স্তর পার করেছি আমার জ্যেঠুর আন্তরিকতায় ও স্নেহে । আজ আমি বেতারেও সর্বসাধারণ বিভাগের ভাওয়াইয়া ও লোকগীতি শিল্পী ।

১৯৯০ সালে ব্লক স্তরে ভাওয়াইয়া সংগীত প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্হানাধিকারী হয়ে রাজ্য প্রতিযোগিতায়ও দ্বিতীয় স্হান অধিকার করি। সেদিনের স্টেজেই অল ইণ্ডিয়া রেডিওর উচ্চপদাধিকারী নিধি নারায়ন বাবু আমাকে কোলে তুলে ডেকে নিলেন শিশুশিল্পী হিসেবে রেডিওতে গান গাইতে। হলদিবাড়ি রাজ্য ভাওয়াইয়া ‘ দরিয়া’ বিভাগে দ্বিতীয় স্হান অধিকার করি। প্রতি বছরই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাকি। ১৯৯২ সালে সি, সি, আর, টি মেধা প্রতিযোগিতায় বৃত্তি পাই। ছয় মাস পর পর দশ বছর বৃত্তি পেয়েছি।

এরই মধ্যে ১৯৯৩ এ ১৩ই মার্চ উত্তর বঙ্গ সংবাদের শিশু কিশোর আসরে আমার ছবি সহ প্রকাশিত হয় ‘ বড় হতে চায় হৈমন্তী’। ১৯৯৫ সালে হলদিবাড়ি রাজ্য ছাত্র যুব উৎসবে ছয়টি বিভাগে পুরস্কৃত হই। আবৃত্তি, রবীন্দ্র সংগীত ও লোকগীতিতে প্রথম স্হান অধিকার করি, নজরুল গীতি, আধুনিক ও তাৎক্ষনিক বক্তৃতায় দ্বিতীয় স্হান অধিকার করি। ১৯৯৯ সালে রাজ্য ভাওয়াইয়া সংগীত প্রতিযোগিতায় ‘চটকা’ বিভাগে দ্বিতীয় হই। ময়নাগুড়ির দীপ্তি রায়ের কাছে কিছুদিন তালিম নিয়েছি। এর মধ্যে ভাওয়াইয়ার পাঁচ বছরের কোর্স ‘ মুকুট মণি ‘ পূর্ণ করেছি। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ২০০৩ সালে হলদিবাড়ি কলেজ থেকে বাংলা অনার্স নিয়ে পাশ করি। নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি থেকে মাষ্টার ডিগ্রি শেষ করি ২০০৬ সালে। আমার কুড়ি বছর বয়স কালে দিল্লিতে অল ইণ্ডিয়া প্রতিযোগিতায় আমি ফোক গানে অংশ গ্রহন করি। ২০০৫ সালে শিলিগুড়ি দীনবন্ধু মঞ্চে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত একাডেমি আয়োজিত কর্মশালায় প্রতিথযশা শিল্পী ‘ অমর পালের ‘ কাছে এক সপ্তাহ শেখার সুযোগ পাই।

২০০৫ সাল থেকে আমার স্টেজে গান গাওয়া শুরু হয়। আসাম, নেপাল, পশ্চিমবঙ্গের সব জেলাতেই গান গেয়েছি। ‘কোচবিহার রাজবাড়ি’কে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষনার দিনে আমি সেখানের অনুষ্ঠানে গান গাই। তিস্তা – গঙ্গা উৎসবে প্রতিবার যখন যেখানে হত সেখানে গান গাইতাম। ২০০৮ সালে কোচবিহার বানেশ্বরের খাবসা হাইস্কুলে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তদশ রাজ্য ভাওয়াইয়া প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় আমি ভাওয়াইয়া গানের ‘চটকা’ ও ‘দরিয়া’ দুটো বিভাগেই প্রথম হই। এই পুরস্কার গ্রহণ করি কলকাতায় রাজ্যপালের কাছ থেকে। এর পর থেকে ব্লক ভাওয়াইয়া অনুষ্ঠানগুলোতে প্রতিবারই বিচারকের আসন গ্রহন করি। রাজ্য ভাওয়াইয়ায় প্রত্যেক বার গেষ্ট আর্টিস্ট হিসেবে যাই।

আকাশবাণীতে গান গাওয়ার সুবাদেই সহজেই নজরে আসে ক্যাজুয়াল ঘোষিকা নেওয়া হবে। থিওরিটিক্যাল পরীক্ষায় পাশ করে প্র্যকটিক্যাল দিয়েছি। পরীক্ষায় পাশ করার পর ট্রেনিং করিয়ে আমাকে ঘোষিকা হিসেবে নিযুক্ত করলেন। ২০০৭ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ঘোষিকা হিসেবে কাজ করেছি। এর মাঝে ২০১০ এ আমার বিবাহ হয় । শ্রী নিত্যানন্দ রায় প্রামানিক আমার স্বামী । উনি খুব ভাল শ্রী খোল বাজান। বিয়ের পর থেকে সব জায়গায় উনিই আমাকে নিয়ে যান। বাবা আমাকে যেভাবে সব জায়গায় নিয়ে যেতেন আমার স্বামীও আমাকে নিয়ে যান প্রয়োজনে গানের সঙ্গত দেন। প্রতিবছর আমার গুরুদেবের সার্বভৌম সম্মিলনী অনুষ্ঠানে আমার স্বামীর শ্রীখোল বাজনার সাথে আমি গান গাই। দূরদর্শনেও ভাওয়াইয়া গান গেয়েছি।২০১৪ সালে ২২শে নভেম্বর শ্রীমতী পেজে আমার গান সম্বন্ধীয় কথা লেখা হয়। প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীর উপস্হিতিতে জলপাইগুড়িতে অনুষ্ঠানে গান গাই। রায়গঞ্জে স্কুলের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে বাপি লাহিড়ির অনুষ্ঠানে সা রে গা মা পা খ্যাত ঋষির সাথে একই স্টেজে গান গাওয়ার সুযোগ পাই। মালদায় রাঘব চট্টোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্ত , স্বাগতালক্ষী দাশগুপ্তের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ পাই। কলকাতায় সল্ট লেকে ‘ সুরুচি সংঘের’ দূর্গোৎসবে লোক গানের থিমে “ বাংলা আমার মা” দশদিনের প্রোগ্রামে রোজ প্রোগ্রাম করেছি। প্রতি বছরই দূর্গাপূজো থেকে পুরো শীতকাল আমার প্রোগ্রাম থাকে। কলকাতায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরিজিম এর প্রোগ্রামে পশ্চিমবঙ্গের স্টলে গানে অংশ গ্রহন করি। আমার গুরুদেবের আশীর্বাদে এখনও গান করে যাচ্ছি। ভবিষ্যতেও আরও বড় সুযোগের অপেক্ষায় আছি।