বাপী ঘোষ ,শিলিগুরিঃ তার স্বামী সামান্য গাড়ি চালক। তিনি সামান্য মাধ্যমিক পাশ। সংসারে আর্থিক অবস্থা যে খুব ভালো তা কিন্তু নয়। থাকেন উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার ফালাকাটা থানার জয়চান্দপুর গ্রামে। কিন্তু এই অবস্থা থাকলেও ইচ্ছে থাকলে যে সমাজের জন্য কিছু করা যায় তার জ্বলন্ত উদাহরন এই গ্রাম্য গৃহ বধূ। নাম তার টুকটুকি বর্মণ। প্রসুতি মা ও শিশুদের বাঁচানোর জন্য তিনি দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন। আর তারজন্য সম্প্রতি গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে পুরস্কারও পেয়েছেন।
কদিন আগের ঘটনা। বানি মুন্ডা নামে ৩৪ বছরের এক প্রসুতি মায়ের প্রসব হয় গ্রামের এক বাড়িতে। সদ্য মা হওয়া সেই আদিবাসীর নিকটজন বলতে কেও নেই। টুকটুকি বর্মণ খবরটি পান। তিনি সামান্য আশা কর্মী। খবরটি পেয়েই তিনি সেই মা-কে ফালাকাটা গ্রামীন হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতাল থেকে বলা হয়, এই রোগিণীকে বাঁচানো সম্ভব নয়। একে বাইরে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু অজানা এবং অপরিচিত সদ্য মা হওয়া সেই মহিলাকে কে বাইরে নিয়ে যাবে? তারতো আপনজন বলতে কেও নেই। আশা কর্মী টুকটুকি চিকিৎসকের কাছে প্রশ্ন করেন। তাই সেই মা-কে সেখানেই রাখার আবেদন করেন তিনি। তখন ডাক্তার বলেন, একে বাঁচানো যাবে কিন্তু পাঁচ বোতল রক্ত কে যোগাড় করে দেবে? দায়িত্ব নেন টুকটুকি। তিনি সেখানকার নার্স রীতা রায়, গ্রাম প্রধান সুভাষ রায় সহ অন্য সকলের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করেন। যোগাড় করেন এম্বুলেন্স। আর সেই এম্বুলেন্স নিয়ে সোজা চলে যান আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালে। যোগাড় করে আনেন পাঁচ বোতল রক্ত। সেই রক্ত সংকটজনক সেই মায়ের শরীরে প্রবেশ করানো হয়। আর তাতেই বেঁচে যায় সেই মা। স্বাস্থ্য দফতরের চারদিকে আশা কর্মী টুকটুকির মানবিকতার নজির ছড়িয়ে পড়ে। ফলে গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে টুকটুকিকে পুরস্কারও দেওয়া হয়। এভাবে এক জন মা নয়, গ্রাম এলাকায় রক্তাল্পতায় ভোগা আরও অনেক মা-এর জন্য ছুটছেন টুকটুকি। একদিকে মা-দের মধ্যে প্রচার করা অন্যদিকে অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের জন্যও দিনরাত কাজ করে চলেছেন তিনি। এই রকম নজির বহু আছে। তার কাজ নিয়ে তিনি কবিতাও লিখেছেন। কবিতার কয়েকটি লাইন, আশা দিদি হয়ে আমি-ঘুরি বাড়ি বাড়ি/ আশা হয়ে বেরিয়ে এলাম সমাজের কল্যানে/গর্ভবতী ,প্রসূতি মা শিশুদের বিশেষ খেয়াল রাখবো/ পরিষেবা দেবার জন্য ভালোবেসে কাজ করবো/নিজের নাম ভুলে গিয়ে হয়েছি আজ আশা/ পরিষেবা ও মুখের কথা ভালোবাসা দিয়ে/ হবো মানুষের ভরসা/ সামান্য প্যাকেজ নিয়ম মেনে করছি আমি কাজ/আশা কর্মীদের শপথ এমন পোলিও মুক্ত সমাজ।
আশা কর্মী হিসাবে টুকটুকি কাজ শুরু করেন সাত বছর আগে। তার আগে তিনি দর্জির কাজ করতেন। তিনি বলেন, দর্জির কাজে রোজগার বেশি ছিল। অন্তত আশা কর্মীর কাজের থেকে। কিন্তু তবুও তিনি এই কাজকে মন থেকে ভালোবেসে কাজ শুরু করেন। তার কারন হল, তার কথায়, প্রসূতি ও শিশু মৃত্যু ঠেকানোর কাজ করতে ভালবাসি। যে আদিবাসী মহিলাকে পাঁচ বোতল রক্ত তিনি কদিন আগে যোগাড় করে তিনি মৃত্যু মুখ থেকে ফিরিয়ে আনেন সেই মায়ের রক্তে সংকটজনক অবস্থায় হিমোগ্লবিন ছিল ৪.৪। রক্ত দেওয়ার পর তা স্বাভাবিক হয়। এভাবে গ্রামে প্রসূতি মা ও শিশু স্বাস্থ্যের কোনো কাজে না নেই টুকটুকির। উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট সমাজসেবী তরুন মাইতি জানালেন, তারা টুকটুকির মতো আশা কর্মীকে সেলাম জানাচ্ছেন। স্বাস্থ্য দফতরে টুকটুকির মতো আন্তরিক সব কর্মী ছড়িয়ে পড়লে দেশ ও সমাজের অনেক মঙ্গল।