সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি — লিখেছেন কাজরীদেবী

শিল্পী পালিত ঃ ক্রমশই জমে উঠছে খবরের ঘন্টার আত্মকথা বিভাগ। আমাদের সম্পাদক বাপিদার পরামর্শমতো শুরু হয়েছে এই আত্মকথা বিভাগের জন্য বিভিন্ন গুণী মানুষের লেখা সংগ্রহ করছি। সবাই সাড়াও দিচ্ছেন ভালো। আজ কলকাতার ই কে টি পি ফেজ ওয়ানের পয়মন্তী হাউজিং এস্টেট,বি ৫/২ থেকে খবরের ঘন্টার আত্মকথায় লেখা পাঠিয়েছেন বিশিষ্ট কবি ও লেখিকা কাজরী বসু। চমৎকার লিখেছেন কাজরীদেবী। তাকে খবরের ঘন্টার তরফে অসংখ্য ধন্যবাদ। আসুন পড়ি এই গুণী মহিলার কলমে লেখা তাঁর আত্মকথা—-

কবি বলেন,কবিরে খুঁজো না তাঁহার জীবনচরিতে। কবির জীবন আর কবিতা কি তবে সমান্তরাল রেখা,যাদের কখনো মুখোমুখি দেখা হয় না! এ কথা অবশ্য বলেননি,জীবনচরিত কবির কবিতায় ধরা পড়ে কি না।

তবে ভাবতে গেলে মনে হয়,ধরা পড়ে। কবিতাই আসলে জীবনের মুখ দেখতে পাওয়া স্বচ্ছতোয়া নদী। তাই হয়তো আর এক কবির অমোঘ উচ্চারণ, সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি, এ কথা ভুলে গিয়ে কেউ কেউ নয়,সকলেই কখনো না কখনো কবি হয়ে ওঠে ,আসলে কবিতাই তো সে, যার মাধ্যমে কথার মুখাবয়বের জোটে ব্যঞ্জনার মুখোশ। কবিতার আঙিনায় আলোছায়া হয়ে ঘুরে বেড়ায় কবির বলে ফেলা সত্যটুকু। তাকে সত্য বলে চিনতে পারাই দুষ্কর। সেই প্রাপ্তি কি ছাড়া যায়?

গোপন আত্মপ্রকাশের সেই অমোঘ আকাঙ্ক্ষাতেই হয়তো লিখতে শুরু করেছিলাম কবিতা। প্রথম প্রথম ডায়েরিই ছিল তাদের বাড়িঘর আটচালা । তারপর একটু একটু করে তাদের জায়গা হলো ডায়েরির বাইরের বৃহত্তর জগতে । লিটল ম্যাগাজিনে। বড়ো পত্রিকায়। কাব্য সংকলনে। কাব্যগ্রন্থে।

কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা। ছোট থেকেই তো সবাই কবিতা লিখব ভাবে না। যা যা করবে ভাবে তা লিখে ফেলে পরীক্ষার রচনায়। কেউ বলে ডাক্তার হব,কেউ বলে শিক্ষক। কেউ বিজ্ঞানী। কেউ কেউ অবশ্য লেখে,ভবিষ্যতে লেখক হতে চাই। আমিও এসবের মধ্যেই কিছু লিখতাম হয়তো। মনে নেই। কিন্তু মনে মনে নিজেকে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে ভাবতে খুব ভালো লাগত। নাচ গান সব কিছুই ছিল আমার এক্সট্রা কারিকুলার এর তালিকায়। অত্যুৎসাহী মা বাবা ছিলেন আমার সব শখপূরণের কাণ্ডারী।
সব শেখো। খেলাধুলোও করো। কোথাও কোনো বাধা নেই।

তাই সবই চলত। স্কুলের পরে দুদিন নাচের ক্লাস,শনি রবি গানের। গোয়াবাগান স্ট্রিটে বিশ্বরূপা থিয়েটারের উল্টোদিকে তখন গীতবিতানের উত্তর শাখা। সেখানে ভর্তি হলাম। আসলে গান ছিল রক্তে। ঠাকুরদা কীর্তন গাইতেন। অসাধারণ গলা। গানের প্রতি ভালোবাসাও সেখান থেকেই আসে। নাচ পরে ছেড়ে দিয়েছিলাম,তখন শুধুই রবীন্দ্রনাথের গান। গীতবিতানে প্রতিবছর গানে র‍্যাঙ্ক পাচ্ছি,আনন্দও পাচ্ছি। পরবর্তীতে সঙ্গীতগুরু হিসেবে অর্জন করি সুবিনয় রায়কে। কারণ তাঁকেই বরাবর সেরা বলে মানি। শিখতে গিয়ে দেখি শিক্ষক হিসেবেও তাঁর তুলনা একমাত্র তিনিই।

গানের সঙ্গে সহবাস চলছিল ভালোই কিন্তু একসময় বাধ সাধল কন্ঠস্বর। ফ্যারেনজাইটিসে সর্বক্ষণ কাবু থাকত সে। দুদিন পরপর গলা বসে যায়, ভেঙে যায়। ডক্টর আবীরলাল মুখার্জি, প্রখ্যাত ই এন টি বিশেষজ্ঞকে দেখিয়েও কিছুই হলো না শেষমেষ। গলা খারাপ থাকলে গান বাড়িঘর আর বাথরুমের চৌহদ্দিতেই আটকে থাকে। তার বাইরে বেশি বের করা যায় না তাকে।

বুঝলাম গানকে নেশা পেশা কোনো কিছু হিসেবেই পাব না। সে মধ্যে মধ্যেই ছেড়ে যায় আমায়। মন খারাপ লাগে। কিন্তু জীবনে কিছু বিচ্ছেদ অবধারিত। হাত যে ছাড়ার সে ছাড়বেই। জোর করে কাকেই বা জীবনে ধরে রাখা যায়?
সেই চেষ্টায় কষ্টই শুধু বাড়ে।

গান নিয়ে আর বেশি কিছু ভেবে লাভ নেই,বুঝলাম। মনের দুঃখ মনে, এরপর লেখালেখির দিকে নজর বেশি দেওয়া শুরু,যা ছিল এখনকার ভাষায় আমার দ্বিতীয় ক্রাশ। কবি হিসেবেও চুপিচুপি কখনো কি নিজেকে ভাবিনি?

আমাদের দেশে মেয়েদের একটা বিরাট কাঁটাতার থাকে,যা পেরোনো খুব কঠিন। সেই কাঁটাতার হলো সংসার। মেয়েদের মনই কি আসলে অন্যভাবে তৈরি হয়! হয়তো তাই, একবার সংসারের ঘেরাটোপে ঢুকলেই তার থেকে মুখ বের করে বহির্জগতের স্বাদগ্রহণ, তেমনটা আর হয় না কেন সবার ! অবশ্য সেই স্বাদ পেতে গেলে কাঁটার আঘাত রক্তাক্ত করে এমন নজিরও কম নয়।

কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করতে করতে বিয়ে। বিয়ে হবার পর পুণা চলে গেলাম,আবার ফিরলাম,এম এ পরীক্ষা দিলাম, মা হলাম, আবার ভূপাল, আবার কলকাতায় এসে স্থিতাবস্থা। এবার গুরুদায়িত্ব। মেয়ের লেখাপড়া। সাউথপয়েন্ট স্কুলের প্রবল লেখাপড়ার চাপ নিয়ে নিয়ে মেয়ের সঙ্গে মায়েরও ব্যস্ত জীবন। একার সংসার,শ্বশুরশাশুড়ি অনেক আগেই প্রয়াত, মেয়ের দেখাশোনা করার দায়িত্ব আমারই বেশি।

সংসার সন্তানের ফাঁকফোকরে লেখালেখিটাই শুধু চলে। এর যেহেতু কোনো উচ্চকিত শব্দ নেই! কিন্তু এভাবে কি সত্যিই নিজের একশো শতাংশ উজাড় করে দেওয়া যায়! একটা আকাশচারী ভাবনা মাথায় এল, ডাক পড়ল বাস্তবের মাটিতে। এভাবে কত গল্প কবিতা হারিয়ে যায় তা কি কখনো কেউ ভেবে দেখেছে? কত নির্মাণ মুখ থুবড়ে পড়ে তার কি কোনো ইয়ত্তা আছে?

এই হারিয়ে যাওয়া পড়ে যাওয়াগুলোকেই খুঁজেপেতে এনে দাঁড় করিয়ে আমার যাবতীয় লেখালেখি। আবাসনের স্যুভেনিরে কবিতা লেখার সূচনা। স্যুভেনির কমিটির দায়িত্ব নেওয়া। তখনই দেশ পত্রিকায় কবিতা পাঠিয়ে সম্পাদক কবি জয় গোস্বামীর হাতে লেখা কবিতা নির্বাচিত হবার চিঠি পেয়ে উল্লাস। আনন্দবাজার রবিবাসরীয়তে গল্প বের হওয়ায় আহ্লাদ। তখন অবশ্য ফেসবুক নেই। তাই অ্যাডিকশনও নেই। নিজের মতো এটা ওটা পড়ার অবকাশ আছে। বাড়িতে ছেলেমেয়েদের উঁচু ক্লাসের বাংলাও পড়াতাম তখন। পড়াতে গিয়েই ব্যাকরণ নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ। নতুন করে স্কুলপাঠ্য বইপত্তর নাড়াচাড়া করা। সময় কাটানো নয়,সময়ের সুচারু ব্যবহার।

কবিতা লিখতে সবসময় বেশি ভালোবাসলেও অন্য কিছুও লিখতে ইচ্ছে হয়। বর্তমান গোষ্ঠীর সুখী গৃহকোণ বলে একটি পত্রিকা, সেখানে পর পর চার বছর চারটে রহস্য উপন্যাস প্রকাশ পেল, যদিও তার অনেক অনেক পরে সেগুলো জড়ো করে বই হয়েছে। রহস্য চার। তখন ফেসবুকই সব। প্রকাশকের খোঁজ পাওয়াও এখানেই। এই বইয়ের আগে একটি, পরে দুটি কাব্যগ্রন্থ কবে যেন প্রকাশিত হয়ে গেছে। আর একটি আসছে। সম্ভবত আগামী বইমেলায়।

অনেকগুলি কাব্যসংকলন এসেছে বিভিন্ন কবিদের নিয়ে,সম্পাদনা করেছি কয়েকটার। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে পাওয়া হয়েছে কিছু মানপত্র,পুরস্কার ইত্যাদি। বলার মতো কিছু নয়। আসলে এখানেই তো অনেকের মতো আমারও নিজেকে মেলে ধরা, এখানেই তো আমার কবিতাও কেউ যে পড়তে চাইছেন,তা জানতে পারা।
এখানেই কবিতাগুলোকে হারিয়ে যেতে না দেবার কথা ভাবা আর সেই কারণেই বই ছাপানো । নিজেকে কবি ভাবতে আর অন্য কাউকে ভাবাতে নয়। কারণ, সকলেই কবি নয়,কেউ কেউ কবি। কবিতায় নিজস্ব কাব্যভাষা সৃষ্টি, সেও কি সহজ কাজ! তাই সব কলমচির আর কবি হয়ে ওঠা হয় না। নিজেকে আমি কলমচাষাই ভাবি।

কবিতার পাশাপাশি গল্প লেখা,সেও ফেসবুকে। কারণ, ফেসবুকেই সব পাঠকের অবস্থান। তাদের উৎসাহদান,মন্তব্য, প্রেরণার আস্বাদ। ফেসবুক আসলে অভিনেতাদের কাছে নাট্যমঞ্চের মতো। হাতেগরম প্রতিক্রিয়ার খোলা বাজার। এর কিন্তু অন্য স্বাদ। বই তো আছেই। কে পড়ছে না পড়ছে তা কি আর বুঝছি?

কিন্তু এখানে কে পড়ছে কে পড়ছে না সবই দৃশ্যমান। তাদের ভালোলাগার ছোঁয়াটুকুও যে দৃশ্যমান। পাঠক হিসেবেও নিজেকে দৃশ্যমান করে তোলা,সেও তো ফেসবুকেরই দাক্ষিণ্য।

গান বলি বা কবিতা, এখন মোটামুটি এই অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ। এখানেই শ্রোতা,এখানেই পাঠক। এখানেই আমি নিজে শ্রোতা, নিজে পাঠক। এখানেই বন্ধু, সহচরী, এখানেই অনেকের মতো আমারও নবজন্ম।

কিছু কবিতা সুরারোপিত করি,আগামী দিনে এমনটাই ইচ্ছে। এক আধটায় দিয়েছি সুর। এক আধটা কবিতাও বলেছি শখ করে। এই শখগুলোকেই জলবাতাসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই হলো। এর বেশি আর চাইই বা কি?