করোনা দুর্যোগ সভ্যতার ইতিহাসে নজিরবিহীন, জানালেন ইতিহাসবিদ

বাপি ঘোষ ঃ পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক মহামারী এসেছে কিন্তু এইরকম মহামারীর নজির নেই। খবরের ঘন্টার কাছে করোনা দুর্যোগ নিয়ে এমন অভিমতই জানালেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান তথা অবসরপ্রাপ্ত ইতিহাসের অধ্যাপক ডঃ আনন্দ গোপাল ঘোষ। ডঃ ঘোষ এই করোনা প্রসঙ্গে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে আরও অনেক কথাই জানালেন। তাঁর মুখ দিয়েই পড়ুন নিচের কথাগুলো—

‘পৃথিবীর যে লিখিত ও মৌখিক ইতিহাস আমরা পরম্পরা অনুযায়ী পাই তাতে করোনার মতো এইরকম মহামারী দুর্যোগের নজির নেই। তবে মিথ বা মিথোলজি কিংবা উপকথা লোককথায় আমরা যা পাই তাতে একসময় সভ্যতা ধ্বংসের কথাই বলা আছে। বাইবেল বা পুরানেও সেকথার উল্লেখ রয়েছে।
তবে মহামারীর যে ইতিহাস আছে তাতে একেকটি বিশেষ ভূখন্ডে বিশেষ মহামারী। আর সেসব মহামারী ছিলো নেচার মেড বা প্রকৃতির সৃষ্টি। আমিতো কোনও বিজ্ঞানী নই, একজন সাধারণ নাগরিক, বিভিন্ন প্রতিবেদন দেখে প্রশ্ন জাগছে , এই করোনা ম্যান মেড কিনা। ম্যান মেড না হলে সারা পৃথিবী এভাবে আক্রান্ত হতে পারে না। নেচার মেড হলে একেকটা এলাকা বা একেকটা ভূখণ্ডে তা হবে।
আটলান্টিক মহাসাগরের পাশে বা আমেরিকার কাছে আমরা বসবাস করি না। আমরা চিনের কাছেই থাকি। চিন থেকে আমেরিকা, ইতালিতে তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলো করোনা। আমাদের এখানে এলো একটু দেরিতে, বিদেশ থেকেই এলো। আর এখনও আমেরিকা, ইতালির মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। এখন এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন বিজ্ঞানী বা রাজনীতিকরা। আমি শুধু এটা জোর দিয়ে বলতে পারি, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনার নজির নেই।
অতীত ইতিহাসে কলেরা, প্লেগ হয়েছে। চিকেন পক্স বা জলবসন্তও হয়েছে। পূর্ববঙ্গে খুব কলেরা হোত। তবে সেসব মহামারী সব স্থানে একসঙ্গে হোত না। কখনও এখানে, কখনও গ্রেট ব্রিটেন বা কখনও ইন্দোনেশিয়ায় হয়েছে। পূর্ববঙ্গে খুব জলবসন্ত হোত। ছোটবেলায় জেনেছি, জলবসন্তে অনেক লোক মারা যেতেন। তারপর একদিন সেই বসন্তের প্রতিষেধক আবিষ্কার হলো। থামলো বসন্তের মৃত্যু হার কমলো। তবে টিকা আবিষ্কার এর আগে মানুষ বসন্ত থেকে বাঁচতে শীতলা পুজো করতো খুব।
তখন কালা জ্বরও হোত খুব। ম্যালেরিয়া হোত খুব। তবে সেসব একটি অঞ্চল বা ভূখন্ড ধরেই হোত। মহামারীগুলো ছিলো আঞ্চলিক। পরিবেশ বা ভৌগোলিক কারনে সেসব হোত। যেমন ধরুন উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি এলাকায় ঘ্যাঘও হোত, এই ঘ্যাঘ কিন্তু বাঁকুড়ায় হোত না।তাই আবারও বলছি, এরকম করোনা মহামারী কিন্তু শাস্ত্র বা লিখিত ও মৌখিক ইতিহাস কোথাও পাইনি।
শিলিগুড়ি জলপাইগুড়িতে খুব ম্যালেরিয়া বা কালা জ্বর হোত। শিলিগুড়িতে আমরা তরাই ফিভারের ইতিহাসও পাই। ম্যালেরিয়া কালাজ্বরে একসময় অনেক ইংরেজ সাহেবও মারা গিয়েছেন পরাধীন ভারতে। জলপাইগুড়ি ডিভিশনাল হেড কোয়ার্টারের ডাক ঘর থেকে একসময় খুব ম্যালেরিয়ার ট্যাবলেট বিলি করা হোত। চা বাগান থেকে অনেক শ্রমিক একসময় জলপাইগুড়ি ডিভিশনাল হেড কোয়ার্টার এর পোস্ট অফিস থেকে ম্যালেরিয়ার ট্যাবলেট নিয়ে যেতেন।
ইতিহাসের পাতায় রয়েছে, তরাই ফিভারে ১৮৫৭/১৮৫৮ সালে মারা গিয়েছিলেন লেডি ক্যানিং। দার্জিলিং থেকে গর্ভনর বা ভাইসরয় লর্ড ক্যানিংয়ের স্ত্রী লেডি ক্যানিং ফেরার সময় তরাই ফিভারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
করোনা সতর্কতার জন্য লকডাউন চলছে দেশে। মানুষ ঘরবন্দি। ১৯৪৩ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। ১৯৪৬ সালে হয়েছিল দাঙ্গা। আর ১৯৪৭ সালে হয়েছিল দেশ বিভাগ। সেইসময় কিন্তু বাংলার সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত বেশ সমৃদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু সেইসব দুর্যোগের সময় কখনো এই করোনার মতো ধনী দরিদ্র সবাই একসঙ্গে বিপাকে পড়েনি। দুর্ভিক্ষের সময় সমাজের তথাকথিত বিত্তবানেরাও এরকম সমস্যায় পড়েননি। যার সম্পদ ছিলো, দুর্ভিক্ষের সময় বেঁচে গিয়েছেন। কিন্তু করোনা দশ তলা বিল্ডিং থেকে বস্তির ভাঙা ঘর, কাওকে ছাড়ছে না।
লকডাউনের এই সময় আমি কদিন ধরে পড়ছি, লিখছি। এত লেখা লিখছি যে বিগত একবছরেও এত লিখিনি। রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড ত্যাগের ওপর একটি বিরাট লেখা লিখছি। বই আকারে তা বের হবে। কিন্তু লেখার ফাঁকে মাঝেমধ্যে মনে প্রশ্ন জাগছে, আমি, আমার পরিবার, আমার সমাজ, আমার দেশ সব ঠিকঠাক থাকবেতো? করোনার এই দুর্যোগ কবে থামে সেদিকেই তাকিয়ে। এই অস্থির অবস্থাতে সৃজন কাজ করা খুব কষ্টকর। ছেলেমেয়েরাও সব ঘরে ঘরে চিন্তিত। তবুও যারা সৃজন কাজে মেতেছেন, যারা লিখছেন, ছবি আঁকছেন, চঞ্চল মনকে বশে এনে ভালো দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন — বলবো, এই দুর্যোগে বিরাট সৃজন, বিরাট কাজ। সবাই ভালো থাকুন। করোনা নিয়ে সতর্ক থাকুন। ঘরে থাকাই এখন জরুরি।’