আবহাওয়া পরিবর্তনের এইসময় করোনা ভাইরাসের কি হবে, সেদিকে তাকিয়ে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ

বাপি ঘোষ ঃ এই সময় আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটছে ভারতে। আবহাওয়া পরিবর্তনের এই সময় করোনা ভাইরাস কতটা টিকে থাকতে পারবে, সেই দিকে তাকিয়ে রয়েছেন উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ তথা ভুগোল বিভাগের অধ্যাপক ডঃ সুবীর সরকার। করোনা দুর্যোগ নিয়ে ডঃ সরকার খবরের ঘন্টাকে আরও অনেক অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর সেসব অভিমত নিচে মেলে ধরা হলো —-

‘ কিছু পুরনো কাজ জমে ছিলো। পি এইচ ডি স্টুডেন্টদের রিপোর্ট, স্কলারদের কিছু কাজ দেখার বাকি ছিলো। লকডাউনের এই সময়ে কদিন ধরে সেসব দেখার কাজ শেষ করলাম। এখন কখনও টিভিতে খবর বা কার্টুন দেখছি। কিছু ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগও শুরু করেছি।
কতদিন চলবে এই লকডাউন, ঠিক বুঝতে পারছি না। টিভিতে দেখছি বাজারঘাটের অবস্থা। কিছু লোক লকডাউন উপেক্ষা করে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যারা অকারনে সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁরা হাজার হাজার লোক না মরলে বিষয়টি ঠিক বুঝতে পারছেন না। এরা যখন বিষয়টি বুঝতে পারবেন তখন হয়তো থাকবে না কেও!
এই করোনা ভাইরাসের কোনও ওষুধ বা ভ্যাকসিন এখনও বের হয়নি। ভাইরাসটি মানবদেহে মিউটেশন ঘটিয়ে চলেছে। বিজ্ঞানীরাও নতুন ভাইরাসটির সঙ্গে অভ্যস্ত নন। কাজেই এত তাড়াতাড়ি ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে তা এখন বলা যাচ্ছে না। তবে এখন আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটছে। অতীতে দেখা গিয়েছে, আবহাওয়া পরিবর্তনের অবস্থায় বহু ভাইরাস চির ঘুমে চলে গিয়েছে। করোনার ক্ষেত্রেও তেমন হচ্ছে কিনা সেই দিকে তাকিয়ে আছি ।এখন তাপমাত্রা বাড়ছে, আপেক্ষিক আদ্রতা কমে যাচ্ছে। এই অবস্থায় করোনার ভাইরাসটি কিভাবে রিয়্যাক্ট করে সেটা লক্ষ্য রাখার দিক। ভাইরাসটির চরিত্রও এখনও ভালো করে বুঝে উঠতে পারেনি মানুষ, সেটাও চিন্তার বইকি। ভাইরাসের জন্ম মৃত্যু নেই। এরা এক স্থান থেকে আরেকস্থানে গিয়ে চির ঘুমে চলে যায়। করোনার ক্ষেত্রেও যদি তেমন হয় তবে আমরা বেঁচে যাবো। আর তা যদি না হয় তবে ছমাস একবছর, যতদিন এই ভাইরাস থাকবে, মানুষকে এভাবেই লড়াই করে সতর্কতা মেনে বেঁচে থাকতে হবে।
এদিকে অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর এক অবস্থা। এত উন্নতি, এত সুযোগসুবিধা হয়েছে আজ মানবসভ্যতার। কিন্তু এরকম ডিজাস্টার মানব সমাজ দেখে নি।
অতীতে অনেক দুর্ভিক্ষ, অনেক মহামারী হয়েছে। তখন মানুষের ক্ষমতা আজকের দিনের মানুষের মতো ছিলো না। অতীতে মানুষের চাহিদাও কম ছিলো। ওষুধও এত পাওয়া যেতো না। ফলে মানুষ এমনেই মারা যেতো । তাছাড়া তখন যোগাযোগ ব্যবস্থাও এত উন্নত ছিলো না। গরুর গাড়ি চলাচল করতো আমাদের দেশে। মহামারীও দ্রুত এক দেশ থেকে আর এক দেশে এরকম দ্রুত ছড়িয়ে পড়তো না। এখনতো বিমান যোগাযোগ হয়েছে। রোগ এক দেশ থেকে আর এক দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারছে।
অতীতে এরকম মহামারী হলে মানুষ বেশি বেশি করে ভগবানে বিশ্বাসী হয়ে পড়তেন। রোগগুলোকে ভগবানের অভিশাপ বলে মেনে নিতেন। কিন্তু আজ সেই অবস্থা নেই। এখনতো মানুষ নিজেকেই ভগবান ভাবে। এখন প্রশ্ন হলো, এইরকম করোনা দুর্যোগ আমরা বা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কিভাবে লড়াই করে পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
পুরনো দিনে বিশেষজ্ঞ ম্যাল থাস একটি তত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই যে হু হু করে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে, ফলে এত মানুষের খাবার-দাবার এর সম্পদ উৎপাদনে সমস্যা হলে প্রকৃতি নিজেই তাঁর কাজে নামে। প্রকৃতি নিজেই মহামারী বা দুর্ভিক্ষ লাগিয়ে দেয়। তাতে লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়। আর তাতে জনসংখ্যা ব্যবস্থায় ভারসাম্য আসে। এটা ছিলো একটা কনসেপ্ট। এর ওপর অনেক আলোচনা, চিন্তাভাবনা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে বিজ্ঞান প্রযুক্তি আরও উন্নত হতে থাকায় মানুষের হাতে আরও ক্ষমতা বা আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। ফলে পুরনো ম্যাল থাসের তত্ব বাতিল হয়ে যায়। মানুষ দেখিয়ে দেয়, তার হাতে অনেক ক্ষমতা আসায় সে বহু সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে। অনেক শক্তিকে মানুষ তার উন্নয়নে রুপান্তরিত করেছে। তাতে বিশ্ব জুড়ে অনেক উন্নতিও হয়েছে।
করোনা যদি এক বছর ধরে দাপট চালায়, অনেকে বলছেন এর ফলে পৃথিবীর দূষন কমবে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং থেকে আবহাওয়া পরিবর্তনের অনেক সুফল আসবে। এখন দেখাও যাচ্ছে, বহু পাখি আসছে। অনেক বন্য প্রানী রাস্তায় চলে আসছে। ইতালির মতো দেশে দেখা যাচ্ছে, বিরাট বিরাট কাজের সব পরিকাঠামো ফাঁকা পড়ে আছে। কোনও মানুষ নেই। সব শুনশান। আমাদের এখানের সুন্দর সুন্দর সব রাস্তা পড়ে আছে। যানবাহন নেই। এই পরিস্থিতি নতুন একটি আলোর জন্ম দেবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই নতুন আলো কত খরচ বা কস্টের বিনিময়ে আসবে? ত্রিশ কোটি, পঞ্চাশ কোটি, একশ, নাকি হাজার কোটি? কস্টটা কি? হুর হিসাবতো বলছে, মৃত্যু সংখ্যা ত্রিশ কোটিও হতে পারে। যদি মৃত্যু একশ কোটিতে পৌঁছয় তবেতো প্রায় অর্ধেক মানুষই শেষ হয়ে যাবে।
অতীতেও অনেক মহামারী গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে দিয়েছে। তাই সেই পরিস্থিতি পুর্নবার আটকাতেই কিন্তু লকডাউন শুরু হয়েছে। লকডাউন হলে মৃত্যু সংখ্যা কমানো যাবে।
চিনতো দারুণভাবে করোনা থেকে নিজেদের সামলে নিয়েছে। ওটা একটা কম্যুনিস্ট দেশ। কাজেই সেখানে কেও সরকারের কথা শুনবে না ভাবা যায় না। একদিকে চিন তাদের সামলে নিলেও ইতালিতে উন্নত সমাজ, তারা প্রথমে লকডাউন সেভাবে মানেনি। তারা লকডাউন উপেক্ষা করে স্ফূর্তি করেছে। এরপর স্পেন,ফ্রান্স, ব্রিটেন সবশেষে আমেরিকা। কি অবস্থা হয়েছে তাদের।
ভারতে লকডাউনের শুরু বেশ ভালো হয়েছে। কিন্ত ভারতে আবার ধর্ম এসে যায়। তারপর গণতন্ত্রের জন্য সবেতেই রাজনীতি। মানবিক ধর্ম পালন করতে গিয়ে এখন বহু ক্ষেত্রে করোনা সতর্কতা মানা হচ্ছে না। টিভিতে দেখছি, লকডাউন উপেক্ষার পালা চলছে। দেশে লকডাউন চলছে তা টিভি দেখেতো বোঝাই যায় না। ত্রান যদি দিতে হয় তবে সেসব পুলিশ, প্রশাসন, সরকারের ত্রান দপ্তরকে দেওয়া হোক না। যার যা কাজ তাঁকে সেটা করতে দেওয়া হোক না। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী সবাই এমনি এমনি লকডাউন করেননি। কিন্তু আশ্চর্য, অনেকে হাল্কা ভাবে নিয়েছেন লকডাউনকে। এই যে ত্রান দেওয়ার নামে হুড়োহুড়ি, এটা কিন্তু আমার মনে হয়, বিরাট একটি ব্লান্ডার। যাকে ত্রান দেওয়া হচ্ছে বা যিনি ত্রান দিচ্ছেন সবাই নিরাপদে আছেনতো? ভাইরাস ঠেকানোর সব নিয়ম মানা হচ্ছেতো? এই ভুল আমাদের বিরাট আত্মঘাতী বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে নাতো?
অর্থনীতি ব্যবস্থারতো দফারফা। বহু মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি তাদের কোম্পানি বন্ধ করতে চলেছে। যুবাদের কাজ চলে যাচ্ছে। এসবতো বিরাট ধাক্কা। বাজারে ক্যাশের যোগান থাকবে কিনা প্রশ্ন রয়েছে। তবে দুর্ভিক্ষ হবে বলে মনে হয় না। দেশে খাদ্য শস্য প্রচুর আছে। উৎপাদনও ভালো।কিন্তু দুঃখ হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী বলা সত্বেও বহু মানুষ লকডাউন হালকাভাবে নিচ্ছেন। রাস্তায় জটলা করে আড্ডা দিচ্ছেন। খুব দুর্ভাগ্য।’