দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের বিনা পয়সায় পড়িয়ে সুন্দর পরিবেশ তৈরি করছেন রায়গঞ্জের এই শিক্ষক

শিল্পী পালিত ঃঃ আজ আমাদের আত্মকথা বিভাগে রায়গঞ্জ কর্নজোড়া স্কুলের শিক্ষক বিপ্লব কুমার মন্ডলের কথা মেলে ধরা হচ্ছে। বিপ্লববাবু নিজেই কলম ধরেছেন খবরের ঘন্টার জন্য।

নমস্কার। আমার নাম বিপ্লব কুমার মণ্ডল ( হেম)। খবরের ঘন্টার পাঠকদের জন্য লিখছি শিল্পীদির আবেদনে৷ ছোট বেলায় আমাকে সবাই বিলে বলে ডাকতো,এই নামটা আমার তেমন পছন্দ ছিল না। কারণ অনেকেই নামটা বিকৃত করে বিল্লি,বিলাই ইত্যাদি বলে খেপাতো খুব। বড়ই রাগ হতো আমার তখন। মা,দিদিমারা সবাই অবশ্য ডাকতেন বিপুল বলে।যাইহোক,যখন বড় হয়ে বুঝলাম বিলে নামটা স্বামী বিবেকানন্দের বাল্য বেলার নাম তখন খুব গর্ব বোধ করতে লাগলাম।একজন মহাপুরুষের নামের সাথে মিল আছে আমার তবুও আমাকে নিয়ে
এতো ব্যঙ্গ ,এতো মজা করা!
ছোট বেলা থেকেই অভাব জিনিসটা কে খুব ভালো করে চিনেছি।যখন বুঝতে শিখলাম, প্রাথমিকের পাঠ পেরিয়ে হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছি তখন অনুভব করলাম অসুস্থ বাবার পক্ষে রেডিও-টিভি সারানোর পয়সায় সংসার চালানো খুবই কষ্ট সাধ্য।
দিনে দিনে তার শ্বাস কষ্টটা বেড়েই চলেছে।মা তখন সামান্য বেতনে বেসরকারী স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।সাথে দু চারটে টিউশন পড়াতেন ।এথেকে যতটুকু আয় হতো তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলতো।বাবার চিকিৎসা,আমার পড়াশুনা এইসব বাড়তি চাপের জন্য মা একে একে তার সব গয়না বিক্রি করে দিচ্ছিলেন।
আমি কোনোরকমে হাই স্কুলের পাঠ শেষ করি।কোনো টিউশন পড়া তো দূরের কথা,নিজেই মায়ের মতন দু চারটে টিউশন ছাত্র অবস্থা থেকেই পড়াতাম।মাধ্যমিকে আশানুরূপ ফল হয়নি তবুও যত টুকু হয়েছে তাতে রায়গঞ্জের করোনেশন, রামকৃষ্ণ স্কুল বা বিদ্যাচক্রের মতন স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সুযোগ পাই।বাড়ি থেকে যাতায়াতের সুবিধার জন্য অবশ্য শেষ পর্যন্ত বিদ্যাচক্রকেই বেছে নিই।মাধ্যমিক পাশ করেছিলাম মশাল দীঘি শিবব্রতি বিদ্যাপীঠ হাই স্কুল, গাজল থেকে।
আগে বাড়ি ছিল ময়নাতে (মালদা)। ভালো স্কুলে সায়েন্স নিয়ে পড়ার আশায় চলে আসি রায়গঞ্জে। মুলি বাঁশের বেড়া ও টিনের ছোট্ট ছাপরা ঘরে বসবাস করতে শুরু করি কর্ণজোরা বারোগণ্ডা গ্রামে।স্কুল জীবনে ছবি আঁকার প্রতি খুব ঝোক ছিল। পেন্সিল স্কেচ, জল রং ,তেল রং সবই ভালো লাগতো।জেলা স্তরে নানা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরষ্কার পেয়েছি অনেকবার।কিন্তু ওই স্তর থেকে আর উপরের দিকে ওঠা হয়নি।
যখন বিদ্যাচক্র থেকে সায়েন্স নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলাম তখন বুঝতে পারলাম সায়েন্স নিয়ে পড়ার আশা এবার ছেড়ে দিতে হবে।অনেক বই,খাতাপত্র,টিউশন এতো সব খরচ আর চালানো সম্ভব নয়। উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে পড়তে বাড়িতেই একটা ছোটো নার্সারি খুলেছিলাম। বিভিন্ন রকম ফল,ফুলের চারা বিক্রি করে সামান্য কিছু আয় হতো।সেটা দিয়ে মা বাবাকে কিছুটা সাহায্য করার চেষ্টা করতাম।অসুস্থ বাবাও চেষ্টা করেছেন কিছু আয় করার। ইলেকট্রনিক এর কাজ ছেড়ে মোটর কালীবাড়ি ১৩ নং ১ কামলাবাড়ী গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসের পাশে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে প্রথমে কিছু চারা গাছ এবং পরে দশকর্মের দোকান খোলেন। বাবার সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।আমি সায়েন্স ছেড়ে দিয়ে ইংলিশ অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে।মন থেকে মুছে গেল ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন।
তখন শুধু একটাই চিন্তা; কি করে কম পুঁজিতে বেশি আয় করা যায়।বাবাকে বাঁচাতে হবে তো। শুরু করি মাটির মূর্তি তৈরি করা।লক্ষী,সরস্বতী,গণেশ, মনসা নানা ঠাকুরের মূর্তি বানিয়ে দশকর্মের দোকানে বিক্রি করতাম। কারো কাছে শিখিনি, অভাবের তাড়নায় নানা সময়ে নানা রকমের কাজের অভিজ্ঞতা তৈরী হয়ে গেছে।কখনো কাঠ মিস্ত্রি,কখনো রাজ মিস্ত্রি আবার কখনো ঠেলা নিয়ে ফেরি করে ফুল ফলের চারা বিক্রি করা। উদেশ্য একটাই — বাবাকে বাঁচানো সাথে নিজের পড়াশুনাও চালিয়ে যাওয়া।কিন্তু কোথায় আর হলো!
যখন বুঝতে পারলাম কোনো কিছুতেই আর বাবার সমস্যা ঠিক হবার নয় তখন হতভাগা এই সন্তান হয়ে ভগবানের কাছে এটাই প্রার্থনা করেছি — তুমি আমার বাবাকে মুক্তি দাও। একজন ছেলে হয়ে বাবার জন্য ভগবানের কাছে মৃত্যু প্রার্থনা করা আর কেউ করেছে কিনা সেটা জানিনা! নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়।কিন্তু কি আর করতাম , বাবার ওই দম নিতে না পারার কষ্টটা দেখলে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারতাম না।শেষ পর্যন্ত ভগবান আমার ডাকে সাড়া দিলেন।বাবা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।সঙ্গে নিয়ে গেলেন এই টুকু সান্তনা আমি ডাক্তার হতে চলেছি।
IMS (INSTITUTE OF MEDICAL SCIENCE) Kolkata আয়ুর্বেদিক কোর্স এ ভর্তি হই।ইংলিশ অনার্স আর কমপ্লিট হলোনা ।পার্ট ওয়ান শেষে পাশ গ্র্যাজুয়েসান পর্যন্ত পড়ে শেষ করলাম।
লেখালেখি চলছিল স্কুল জীবন থেকেই।কবিতা,গান,ছোট গল্পঃ কৌতুক রচনা করতাম সুযোগ পেলেই।কিন্তু সেসবের কোনটা নিয়েই আর বেশি দূর পর্যন্ত এগোতে চাই নি।আসলে নিজেকে এতদিন প্রচারের আড়ালে রেখেছিলাম।বাবা বলতেন – “একদিন তোমার সব হবে ।নাম,দাম সবই পাবে তুমি কিন্তু আমি সেসব দেখে যেতে পারবনা।” তাই নাম আর দাম দুটোই আজ আমার কাছে মূল্যহীন।একসময় মূর্তি বানিয়ে বিক্রি করতাম পেটের তাগিদে,এখন কাগজ কেটে আঠা দিয়ে জুড়ে জিনিস তৈরি করি – শখে ,সময় কাটাতে।জীবনের সাথে মেলানোর চেষ্টা করি খারাপের মধ্য থেকেও কিছু ভালোর সন্ধান পাওয়া যায় কিনা! কিছু নতুন ভাবনা নিয়ে নতুন কিছু করা যায় কিনা।যেখানে আমার মতন উৎসাহী অথচ অভাবী কিছু ছেলে মেয়ে অল্প খরচে এমন কিছু করতে পারে যাতে তার বাঁচার জন্য ন্যুনতম আয়টুকু অতি সহজেই ব্যবস্থা করতে পারে।
আমি ২০১১ এর ২রা ফেব্রুয়ারি থেকে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কাজ করছি।এর আগে ১৯৯৯ সালে ইংলিশ অনার্স ছেড়ে ২০০৩ পর্যন্ত BAMS আয়ুর্বেদিক কোর্স শেষ করে ২০০৩-২০০৭ পর্যন্ত কিষানগঞ্জ (বিহারে) এল, সি ,সি এর মেডিক্যাল অফিসার ছিলাম।২০০৭-২০১০ পর্যন্ত পশ্চিম বঙ্গ সরকারের ভোকেশনাল (প্যারামেডিকেল )HEALTH WORKERS INSTRUCTOR হিসেবে কাজ করি কর্নাজোরা হাই স্কুলে।আমার কর্মজীবনে সব সময় চেষ্টা করেছি আমার কম্পাউন্ডার,সিস্টার অথবা ছাত্র ছাত্রীদের ও এমন কিছু শেখাতে যাতে তারা নিজেও কিছু করতে পারে আবার অপরকেও কিছু করার পথ দেখাতে পারে।
আমি শিক্ষক হিসেবে কাজে যোগ দেয়ার পর থেকে আর কোনো ফী নিই না।আগেও গরীবের কাছে কখনো ফী নিই নি।মনে পড়ে যায় বাবার কথা,কিভাবে নিজের চোখের সামনে বলতে গেলে বিনা চিকিৎসায়ই মারা গেলেন আমার বাবা।
মা বলেন, তুমি ডাক্তার হলে ১০০০ জনকে চিকিৎসা করবে আর মাস্টার হলে ১০০০ জন ডাক্তার তৈরী করার সুযোগ পাবে।তাই ডাক্তার হিসেবে দীর্ঘ দিন কাজ করার পর অনেক টা খেলার ছলে মাস্টারি পরীক্ষায় বসেও যখন উত্তীর্ণ হই তখন মায়ের কথাটা নিয়ে আর বেশি ভাবিনি।যোগ দিলাম প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে।
আমি একটা সংস্থা খুলেছি”
RAIGANJ RAMCHANDRA ACADEMY OF CULTURAL EDUCATION AND HEALTH IMPROVEMENT SOCIETY”
রেজিষ্টেশন নং ৭৩০০০ সাল (২০১০-২০১১)।
নানা রকম সেবা মূলক কাজ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
নতুন পোশাক তো দিতে ইচ্ছে করে কিন্তু পারিনা তাই পুরনো বস্ত্র বিতরণ করি।যাদের আছে তাদের কাছ থেকে নিয়ে গরিবদের দিই।
চিকিৎসা করাতে পারিনা বলে অসুখবিসুখ যাতে না হয় বা কম হয় তার জন্য প্রিভেনটিভ হেলথ কেয়ার ট্রেনিং দিই।
চারা কিনে গাছ লাগানোর খরচ না জোগাতে পেরে বীজ সংগ্রহ করে তা বিতরণ করি।এভাবেই এগিয়ে চলেছি।
গল্পঃ কবিতা এখন আর কারো পড়ার সময় আছে?
বেশি লিখি না আর ।যদিও বা লিখি,সেসব বই করে ছাপানোর আশা করিনা।ছোট ছোট লেখা গুলো ফেসবুকে দিই ছেড়ে। ফেসবুকে এই মুহূর্তে হয়তো ৫০০-৬০০ লেখা আছে যার মধ্যে কবিতা ই বেশি ।এমন আরও শ পাঁচেক কবিতা ও গান লিখেছি যা খাতা বা মোবাইলের কোণে অনাদরে পরে আছে।
জীবন বিপ্লব নামে আমার আত্মজীবনী মূলক কাব্য যার মধ্যে ৪০ টি কবিতা আছে সেটি এখনও এডিট করাই হয়নি।নিজের সম্পর্কে বলতে বা লিখতে বড় সংকোচ বোধ হয়। কোনো গঠনমূলক লেখাই এখন আর বেশি কারো পড়ার সময় নেই। আমি নিছক ই এক তুচ্ছ ব্যক্তি কি আর লিখবো নিজেকে নিয়ে! কার জন্যই বা লিখবো?
বুঝতে পারি লোকের সময়ের বড়ই অভাব। ফেসবুকে একটা ছবি দিলে লাইক,কমেন্টে পৃষ্ঠা ভরে যায় আর লেখা গুলো বুঝিয়ে দেয় এখন পাঠকের চাইতে লেখকের সংখ্যাই বোধ হয় বেশি। নিজের সম্পর্কে বলার জন্য নয় আমার ভাবনা কে শেয়ার করার জন্য এই লেখা।
অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে এগিয়ে চলেছি। জীবনে এমন কিছু যদি করতে পারি যাতে আমার চিন্তা ভাবনা কাজে লাগিয়ে কেউ বেচেঁ থাকার পথ খুঁজে পায় তবে নামের সার্থকতা তার মাঝেই খুঁজে পাবো সফল হবে সেদিন আমার জীবনের বিপ্লব।