শিল্পী পালিত ঃ আজ আত্মকথায় ভাইয়ের কথা মেলে ধরলেন দিদি। দিদি সঙ্গীত শিল্পী অনিন্দিতা চ্যাটার্জী। তিনি লিখেছেন তাঁর ভাই অনির্বাণ ঘোষের কথা —
দিদি হয়ে ভাইয়ের জন্য গর্ব বোধ করি। ভাই আমার থেকে এক বছর তিন মাসের ছোট।
আমরা ইসলামপুরে বেড়ে উঠেছি। ভাই ছোট থেকেই পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। খুব কম পড়াশোনায় বেশি নম্বর পেত। চতুর্থ ও অষ্টম, দুটো শ্রেণীতেই বৃত্তি পেয়েছিল।ছোটবেলা অঙ্কন, কবিতায় ও খুব ভালো ছিল, অনেক পুরস্কার পেয়েছিল। এছাড়া নাটক, তবলা সব কিছুই করতো ভাই। বিজ্ঞানের মডেল তৈরি করে জেলায় প্রথম হয়ে কলকাতার বিড়লা প্লানেটেরিয়ামে রাজ্য স্তরে যোগ দিয়েছিল।সেটা ছিল ১৯৮৫-৮৬ সাল।
ভাইয়ের এই সফলতায় গোটা ইসলামপুর খুশিতে মেতে উঠেছিল। ইসলামপুর আমাদের জন্য পছন্দের জায়গা ছিল। মাধ্যমিকে ভাই ষ্টার পেল। বাবা চাকরি করে যা পেতেন তাতে কিছু শেখানো সম্ভব হত না। বাবা টিউশন করতেন। মা শাড়ির ব্যবসা করতেন। আমাদের বাবা মা তাদের সারাজীবন আমাদের জন্য উৎসর্গ করেছেন। বাবা কোনোদিন একটা পানও খেতেন না। বাড়িতে একটা মিষ্টি আনলে সেটাও চার ভাগ করে খেতেন। মাধ্যমিক পাশ করে ইসলামপুর থেকে শিলিগুড়িতে আসা হল এগারো শ্রেণীতে পড়ার জন্য। যেকোনো কারণেই হোক শিলিগুড়ি বয়েজ হোস্টেল হল ভাইয়ের ঠিকানা। আমি থাকতাম শিলিগুড়ি গার্লস স্কুলের হস্টেলে। জীবনের কষ্ট আর যুদ্ধ শুরু হল সেই সময় থেকেই। ভাইয়ের হোস্টেলে ঠিক মতো পড়া খাওয়া না পাওয়ার জন্য মা ভাইকে নিয়ে ছোট্ট একটা ঘরে ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। চিলড্রেন পার্কের সামনে ছোট একটা ঘর, যেখানে শুধু চৌকি ফিট করতো সেখানে মা- ভাই থাকতেন। বাবার বেতন দিয়ে পড়াশোনা, টিউশন করা সম্ভব হত না বলে মা জীবন বীমার এজেন্সী নিলেন, কাপড়ের ব্যবসা করতেন। মা ১৯৬৭র সময়কার অনার্স গ্রাজুয়েট ছিলেন। বাবাও উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। বাবা-মা র কষ্টের সম্মান আমার ভাই দিয়েছিল। আমরা ভাই-দিদি সব সময় বাবা মার সুখ নিয়ে ভাবতাম।
সুসন্তানের উদাহরণের নাম অনির্বান ঘোষ, অনিন্দিতা চ্যাটার্জীর ভাই। আজকে যে মুম্বাই নিবাসী সুদক্ষ যন্ত্রবিদ। আজ দেশে বিদেশে বিশ্বের বড়ো শিল্পপতিদের সাথে ভাই মিটিং এ বসেন, ফ্লাইটে যাতায়াত করে, বিদেশের বড়ো কনফারেন্সগুলোয় উপস্থিত হয়।
জলপাইগুড়ি পলিটেকনিক কলেজে পড়তে পড়তেই শিলিগুড়ির বড়ো মোটর কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায় ভাই। সেখানে টাকা জমিয়ে ভাই মুম্বাই তে গিয়ে কাজ করা শুরু করল। প্রথমে ভাবা রিসার্চ সেন্টার,AD-TECH-1.5 years, Techno- craft plasma এক বছর, Becto chem Eng’s-ছয় মাস, Roop tel sonic -7.5 বছর, hilti -5বছর,এখন JLG-8 বছর ধরে কাজ করছে। মাত্র ২১ বছর বয়সে মুম্বাইর মতো ব্যস্ত জায়গায় একা থাকা শুরু। প্রথম দশ বছর খুব কষ্ট করে মুম্বাইয়ে কাটিয়েছে। যখন ধীরে ধীরে ভালো চাকরি পেয়ে বড়ো কোম্পানিতে যোগ দিলো তখন মিরা রোডে গিয়ে ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকা শুরু করল। সেখানে থেকে কিছুদিনের মধ্যেই ভাই অনেক বড়ো ফ্ল্যাট কিনে ফেললো। মা- বাবা সুখের দিন দেখতে পেল। আজ সবটাই ওর একার পরিশ্রমের ফল। আমার চোখে মা- বাবার একজন যোগ্য সন্তান বলে যদি কিছু থাকে সেটা অনির্বান ঘোষ। ইসলামপুরের ছেলে বলে শিলিগুড়িতে অনেক পরিচিত বন্ধু একটু অবহেলার চোখেই ওকে দেখতো। আজকে বি এম ডব্লু কেনার পরে সেই বন্ধুগুলো ওকে নিয়ে আলোচনা করতে থাকলো। অনি কত বড়ো জায়গায় পৌঁছেছে! মা র হাঁটু অপারেশন -বাবার কঠিন রোগের চিকিৎসা সবটাই মুম্বাইর সবচেয়ে বড়ো ডাক্তার ও সবচেয়ে বড়ো হাসপাতালে দেখিয়েছিল। বাবা -মা কে ভারতবর্ষের প্রায় সব জায়গায় নিয়ে যায়। যেমন -গোয়া, পুনে, সিমলা, দিল্লী, তামিলনাড়ু -কন্যাকুমারী, -কেরালা, দমন, মুম্বাই র আশেপাশে beach, Pune Hyat, তাজ mumbai oberai,তাজ হোটেল, surat, জয়পুর, ঔরঙ্গাবাদ ইত্যাদি। বাবা র অসুখ ধরা পড়ার পরে সিঙ্গাপুরে ঘুরিয়ে এনেছিল। বাবা মা জীবনের সব আনন্দ বারো বছরের মধ্যে ভোগ করে নিয়েছিল। নিয়তি মুহূর্তের মধ্যে ভাইয়ের জীবনে, আমার জীবনে সব সুখ কেড়ে নিলো! মানুষ কেউ থাকবে না, সবাই যাবে..কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি ওনারা দুজনেই একসাথেই প্রায় চলে যাবেন এটা আমাদের ভাবার বাইরে ছিল। ভাই অনেক জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ারকে চাকরি, পথ চলতি মানুষকে সাহায্য সব করেছে। দিদি হয়ে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম যখন খবর পেলাম মুকেশ আম্বানি র সাথে মিটিং ওর আছে। বাবার দেখাশোনা, পরিচর্যা, সব সেবামূলক কাজ ও করত। বাবা- মা যেটুকু খুশি, যেটুকু পেয়েছিল তার কারণ ছিল অনির্বান ঘোষ। বেশির ভাগ ছেলে বাবার টাকার উপরে চলে,ঠিক মতো চিকিৎসা করায় না. মৃত্যুর পর বড়ো করে কার্ড ছাপিয়ে মৃত্যুর বা শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করে। আমার ভাই বাবা_মায়ের সুখের জন্য অনেক অর্থ খরচ করেছিল।
বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে? সন্তান চাই না। তবে অনির্বানের মতো সন্তান ভাই সবার ঘরে ঘরে জন্মাক।
E-405, RNA COURTYARD, SHANTI PARK, MUMBAI-401107,