কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, লিখেছেন পূবালী ঘোষচট্টোপাধ্যায়

শিল্পী পালিত ঃ আজ আমাদের খবরের ঘন্টার ওয়েবপোর্টালে একটি ভ্রমন কাহিনী মেলে ধরলেন পূবালী ঘোষচট্টোপাধ্যায়–

আমার ভ্রমণ কথা
পূবালী ঘোষচট্টোপাধ্যায়

কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা,মনে মনে… কবিগুরুর এই কবিতা আমার জীবনে বড় সত্যি হয়ে উঠেছিল ছোটোবেলায়। মনে মনে হারিয়ে গেছি আমি অনেকবার! তবে তা নিয়ে তো ভ্রমণকথা লেখা চলে না!

তাই মনের সঙ্গে সঙ্গে অবয়বটাকে নিয়ে যতবার আমি আমার দেশ ঘুরে বেড়িয়েছি, তাই নিয়েই আমার লেখা। না,রচনা খাতায় লেখা প্রথামাফিক ভ্রমণকাহিনী নয় এটা। এতে শুধু আমার নানান প্রদেশ বেড়ানোর টুকরো স্মৃতির কোলাজ থাকলো।

সে বছরটা আমি কখনও ভুলব না,২০০৫, মার্চ মাসে বিনা নোটিশে আচমকাই মাতৃহারা হ’লাম আমি। বাবাকে আগেই হারিয়েছি, এবার মনে হ’ল মাথার ওপর থেকে বাকি অর্ধেক আকাশও বুঝি সরে গেল।সে যে কি কষ্ট, কাউকে বলতে পারি না,রাতে ঘুম নেই, নোনাজলে বালিশ ভিজে যায় রোজ। মাঝরাতে উঠে বসে থাকি।আমার অবস্থা দেখে আমার কর্তাটি ভাবলেন কোথাও বেড়াতে গেলে আমার মন যদি একটু ভালো হয়! ঠিক হল,সে বছর পুজোয় আমরা রাজস্থান ঘুরতে যাব। আমি,আমার সদ্য দশে পা দেওয়া ছেলে আর কর্তা। ছেলে তো শুনেই অবনঠাকুরের রাজকাহিনী আবার মনদিয়ে পড়ে নিল। ওখানে গিয়ে আমরা দুর্গের পর দু্র্গ দেখে চলেছি।জানছি তার ইতিহাস। সবকথা লিখব না,কিন্তু আমার মন ভরিয়ে দিয়েছিল যে স্থানটি, সেটা হল চিতোরগড়। ইতিহাস যেন কথা বলছিল।কান পাতলে বাতাসে শুনতে পাচ্ছিলাম পদ্মিনীর জহরব্রত পালনের আগুনের লেলিহান শিখার চড়চড় শব্দ! না,অন্যান্য দুর্গগুলোর মত এই দুর্গটি সংরক্ষিত হলেও পরিমার্জিত হয়নি।আধুনিকতার স্পর্শ লাগেনি এর গায়ে। একইভাবে কালের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এই গড়!

আর ভালো লেগেছিল জয়সলমীরের,না সোনার কেল্লা নয়, কারণ,সোনারকেল্লার গায়ে বিকেলের রোদ পড়ে প্রথমদিন হোটেল থেকে যে দৃশ্য আমার মনকে মুগ্ধ করেছিল,পরের দিন কেল্লার ভিতরে ঢুকে চরম মোহভঙ্গ হয়।এ যেন একটা বাজার,তার মাঝে কেল্লার বিভিন্ন কক্ষ রঙ করে বাস করছে মানুষ, ইতিহাসের পরশ হারিয়ে ফেলেছে সেটা।দেখে চোখে জল এসে গিয়েছিল।
কিন্তু পরদিন যখন স্যান্ডডিউনে সূর্যাস্ত দেখতে গিয়ে বালিয়াড়ির ধূ ধূ মরুতে উঠে চড়ে দু’ঘন্টা ঘুরলাম আর মরুসূর্যের অস্তগামী আলোয় স্থানীয় বালিকাদের নৃত্য আর বালকদের বাঁশিতে হারিয়ে গেলাম,ভারি ভালো লেগেছিল।

আর ভালো লেগেছিল ২০১৩ এর ডিসেম্বরে ঈশ্বরের আপন দেশে মানে কেরালায় গিয়ে সেখানকার পাহাড়ি শহর মুন্নারের সবুজ মনকাড়া সৌন্দর্য। মুগ্ধ হয়ে ঘুরেছিলাম চারদিন। কেরালা শহর থেকে দূরে আথিরাপল্লী জলপ্রপাত এর অপূর্ব শোভা আজও মনে আছে।

সব শেষে যার কথা কোলাজে না জুড়লেই নয়,তা হল ২০১৫ তে ঘোরা ভূস্বর্গ কাশ্মীর। এখানে পহেলগামের লীডার নদীর উচ্ছসিত কলতান আর পাহাড় ঘেরা দৃশ্য আজও চোখে ভাসে। আর ঘোড়ায় চেপে পাহাড়ের কোনায় কোনায় তিনঘন্টার কষ্টকর যাত্রা জীবনে ভোলার নয়। দেহকষ্ট আর মনের আনন্দ মিলেমিশে স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে আছে। ডাললেকে শিকারায়

ভাসা,হাউজবোটে রাত্রিবাসের অভিজ্ঞতা, কিছুই কি ভোলবার?২০২০তে লকডাউন এর ঠিক আগে গোয়া আর ইলোরা ঘোরা বড় আনন্দ দিয়েছিল।গোয়ার বিভিন্ন সমুদ্রতটে নীলজলের ঢেউ আর সোনালী বালিতে মানুষের কলরব মন ভরিয়ে দিল কানায় কানায়। ইলোরায় পাহাড় কেটে গুহা বানিয়ে কতযুগ আগের করা মূর্তি খোদাই মনকে সেই যে বিস্ময়ের জগতে নিয়ে গেল,আজও সেখানে পড়ে আছি বুঝি!
কত অজানারে জানাইলে তুমি…

©পূবালী