আসানসোল থেকে শর্মিষ্ঠা দত্ত লিখলেন, সাধারণ মেয়ের গল্প

শিল্পী পালিতঃ আজ এই ওয়েবপোর্টালে আসানসোল থেকে লিখেছেন শর্মিষ্ঠা দত্ত —

সাধারণ মেয়ের গল্প/শর্মিষ্ঠা দত্ত

আজ একটা গল্প বলব…. নিতান্ত সাধারণ মেয়ের গল্প l জীবন নদীর মত, জীবনপ্রবাহ অবিরাম বয়ে যায় l মোহনার কাছাকাছি পৌঁছে আজ সেই মেয়ে ফিরে তাকিয়েছে তার উৎসের দিকে l ক্রমশ নিম্নগামী এই স্রোতস্বিনীর গল্পে তেমন কোনো আলোড়ন নেই l তবু নেই কি ! নিজের অস্তিত্ব, নিজস্ব পরিচিতির জন্য অদৃশ্য এক নিরুচ্চার যুদ্ধে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হতে হতে আনন্দ খুঁজে নেওয়ার মধ্যেই সে খুঁজে নিয়েছে জীবনের সার্থকতা l

সত্তর বা আশির দশকে আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের জীবন যে খাতে বইত… তার থেকে বিন্দুমাত্র তফাৎ নেই তার জীবনে l জন্ম মধ্যকলকাতায়, এক ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের তৃতীয় সন্তান l যৌথ পরিবার l ঠাকুমা, কাকারা, পিসি… পরে অবশ্য ছোট বাড়িতে স্থান সংকুলান হচ্ছিল না বলে বাবা – মা আলাদা বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন l তবে পরিবারের মানুষদের মধ্যে প্রতিদিনই আসাযাওয়া, দেখাশোনা চলতেই থাকত l এতটাই দৃঢ় ছিল বন্ধন l আসলে মা – বাবা সবাইকে নিয়ে থাকতে ভালোবাসতেন l জেঠতুতো, খুড়তুতো, মাসতুতো ভাইবোনের সংখ্যা নেহাৎ কম ছিল না l তাদের মাঝখানেই বড় হয়ে উঠছিল মেয়েটা l বাবা বেসরকারি সংস্থার মোটামুটি উচ্চপদস্থ কর্মী হলেও সংসারে তেমন একটা সচ্ছ্বলতা ছিল না l কিন্তু সেজন্য তিন বোনের মনে কোনো দৈন্য বা অভাববোধও ছিল না l আসলে সেই সময়টাই ছিল অন্যরকম l খুব ছোট ছোট বিষয় থেকেই আনন্দের নির্যাসটুকু বেরিয়ে আসত l বিজ্ঞাপনের হাতছানি বা কোনো প্রলোভনে ছিল না সামনে l সুন্দর একটা সাংস্কৃতিক বোধ খুব ছোটবেলা থেকেই মনের মধ্যে জারিত হয়ে গিয়েছিল l কারণটা তার মা l মা ভালো গান গাইতেন, লেখাপড়াতেও ভালো ছিলেন l যদিও বড় সংসার সামলে এবং তিন মেয়েকে বড় করে তুলতে গিয়ে আলাদা কোনো পরিচিতি ছিল না তাঁর l মায়ের মত তাঁর মেয়েরাও ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীত আর সাহিত্যকে ভালোবাসতে শিখেছিল l প্রচুর বই ছিল বাড়িতে, গোটা তিনেক লাইব্রেরির মেম্বারশিপও ছিল l মায়ের মত রাত জেগে বই পড়ার অভ্যেস এখনও এই মাঝবয়েসেও রয়েছে মেয়েটার l বাড়িতে তিনবোনের বন্ধুবান্ধবের ছিল অবারিত দ্বার l মায়ের সঙ্গেও ছিল তাদের অনাবিল সখ্যতা l যে কোনো সময়েই এসে উপস্থিত হত কেউ না কেউ, নানা বিষয়ে সবাই মিলে দারুণ প্রাণখোলা আড্ডা হত বাড়িতে l
মেয়েটা ছিল একটু সৃষ্টিছাড়া l নিজের নামকরণটিও তার নিজস্ব l আসলে ছোটবেলা থেকেই রুচিবোধটি তার প্রবল l অন্য একটা ভালো নাম দেওয়া হয়েছিল তাকে, তা সত্ত্বেও ঠাকুমা আর মায়ের মুখে গল্প শুনে শুনে মহাভারতের এই চরিত্রের নামটি খুব পছন্দ হয়ে যায় l

সে কিন্তু হাতেপায়ে একেবারেই দুষ্টু ছিল না l কিন্তু তার বিজ্ঞ বিজ্ঞ হাবভাব আর বাক্যি শুনে বাড়ির লোকজন বাক্যিহারা হয়ে যেত প্রায়ই l তার এক মাসি ডাকনাম ঝুমার বদলে তাকে ডাকতেন ঝুনা বলে, কারণ তার হাবভাবের সঙ্গে নাকি ঝুনো নারকেলের প্রচুর সাদৃশ্য ছিল l আর একটু বড় হয়ে অবশ্য ‘সবজান্তা দুলিরাম’ উপাধিও প্রাপ্তি হয়েছিল তার ! যখন বছর তিনেক বয়েস, দিদিরা তখন ক্লাস ফোর -ফাইভের ছাত্রী, ধারাবাহিকভাবে হয়ে আসা স্কুলের ফার্স্ট গার্ল l এদিকে সেই স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রবল ইচ্ছে তার l প্রচুর ছড়া, এমনকি দিদিদের বইয়ের বড় বড় কবিতাও শুনে শুনে মুখস্থ, অথচ লিখতেই শেখেনি তখনও l উৎরোবে না জেনেই মা তাকে এডমিশন টেস্ট দিতেও নিয়ে যাননি l এদিকে মায়ের কোলে চড়ে দিদিদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার সুবাদে ফুটফুটে পুতুলের মত মেয়েটা সব দিদিমণিরই বড্ড প্ৰিয় l অতএব একরকম নিয়ম ভেঙেই শুধুমাত্র মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে তাকে তো নার্সারি ক্লাসে ভর্তি করা হল l তারপর থেকে সেই মেয়ে দিদিমণির কোলে চেপে ক্লাসে যায়, ক্লাস চলাকালীন উদাস হয়ে আকাশ দেখে l ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতে বললে জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ট্রেন দেখতে দেখতে চাইনিজ কাট চুলের ফাঁক দিয়ে ফিচেল হেসে বলে, “আমি তো লিখতে শিখিনি !” হতাশ দিদিমণি বলেন, “তাহলে তুমি কি শিখেছ শর্মিষ্ঠা?” সে বলে, “আমি শুধু গোল্লা দিতে শিখেছি l” ক্লাসওয়ার্কের খাতার পাতা গোল্লা দিতে দিতেই শেষ হয়ে যায় l হাফইয়ার্লি পরীক্ষার রিপোর্টকার্ডেও সেই গোল্লা ফেরৎ আসে l যদিও ততদিনে সে অল্পস্বল্প লিখতে শিখেছে l তবু “লেখোনি কেন?” এই প্রশ্নের নির্বিকার জবাব দেয়, “দেখছো না আমার কত ছোট ছোট হাত !” তবে মেয়ে কিন্তু বেশ সেয়ানা l হাফইয়ার্লি পরীক্ষায় এসমস্ত এক্সপেরিমেন্ট করলেও অ্যানুয়াল পরীক্ষায় ঠিকঠাক লিখে আসে… নইলে যে প্রমোশন পেয়ে নতুন ক্লাসে ওঠা হবে না, নতুন বইও পাওয়া হবে না ! কিন্তু ওই পর্যন্তই…সিনসিয়ারিটি শব্দটা তার অভিধানে নেই l জীবন সম্পর্কে অসম্ভব উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গী তার l মুহূর্তের ভালোলাগা নিয়ে সে বাঁচে l যখন যেটা ভালো লাগে, সেটাই করে… ভালো না লাগলে সে কাজটা কেউ আর তাকে দিয়ে করাতে পারে না l এভাবেই বড় হতে থাকে সে l লেখাপড়ার সঙ্গে সমানতালে চলতে থাকে গানশেখা… শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি l আরো বড় হয়ে বিখ্যাত এক প্রতিষ্ঠানে প্রবাদপ্রতিম শিল্পীদের কাছে শেখার সুযোগ l আর না শিখেই একটু আধটু ছবি আঁকা l গান, আঁকায় কয়েকটা প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও জুটে যায় l ছোটোখাটো অনুষ্ঠানেও ডাক পায় l এরই মধ্যে পরপর দুবছর রাজ্যস্তরে যোগব্যায়ামেও প্রথম পুরস্কার পায় সে l কিন্তু আলস্য যার মজ্জাগত, শরীরচর্চা কি তার পছন্দের বিষয় হতে পারে ! ততদিনে সে উপলব্ধি করতে পেরেছে তার প্ৰিয় বিষয় সাহিত্য l রাবীন্দ্রিক দর্শনে অনুপ্রাণিত সে l রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছে রীতিমতো l নিজের মৌলিক চিন্তাভাবনা প্রকাশের সুপ্ত ইচ্ছেটা ডানা মেলছিল, তাই উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডী পেরিয়ে বাংলায় অনার্স l যদিও মায়ের ইচ্ছে ছিল মেয়ে অর্থনীতি নিয়ে পড়ুক l বেশ চলছিল লেখাপড়া, গান… আকস্মিক পরিবর্তন এল জীবনে l সবকিছু কেমন উল্টেপাল্টে গেল l কোনো প্রস্তুতি ছিল না, তবু সেকেন্ড ইয়ারে পড়তে পড়তেই হঠাৎ করে বিয়ে হয়ে গেল তার l বর বেশ খানিকটা বড়, ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বার্নপুরে স্টিল প্ল্যান্টে চাকরি করে l বৌয়ের গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়নি, অতএব সে রইল কলকাতায় আর বর বার্নপুরে l প্রায় দুবছর কলকাতা -বার্নপুর যাতায়াতের মধ্যে দিয়ে অনার্স গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার আগেই মাত্র কুড়ি বছর বয়েসে কোলে এল একটা ছোট্ট পুতুল l তাকে নিয়ে এবার বার্নপুরে সংসার করতে এল মেয়েটা l রেজাল্ট যথেষ্ট ভালো এবং ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাওয়া সত্ত্বেও এম এ ক্লাসে ভর্তি হওয়া হল না তার l গানও বিদায় নিল জীবন থেকে l যে মেয়ে নিজের ইচ্ছে ছাড়া কোনোদিন কিছু করেনি, সেই সংসারে নিজেকে বিলিয়ে দিল l সংসার আর বাচ্চা মানুষ করা, দিনের পর দিন এই একঘেয়ে আবর্তে হাঁসফাঁস করতে করতে মুক্তির পথ খুঁজত মেয়েটা l সাদা ডায়েরির পাতায় উজাড় করে দিত জীবনের প্রতি ক্ষোভ, অভিমান l কিন্তু সেসবও তোলা থাকত আলমারির নিভৃত কোণে l এরমধ্যেই আরো একটি পুত্রসন্তানের মা হল সে l বড় ছেলেকে গান শেখানো শুরু করতে করতেই আবার প্রায় একযুগ পরে ভর্তি হল গানের ক্লাসে l আবার প্রায় নতুন করেই শুরু করা…সংসার সামলে প্রাণপণ পরিশ্রম করে অবশেষে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা প্রাপ্তি l এরপর কিছু কিছু অনুষ্ঠানে গান ছাড়াও সঞ্চালনা, আবৃত্তি… এমনকি বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয়ের সুযোগও পেয়েছিল সে l যখন যেমন সুযোগ এসেছে, সবকিছুই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে l অন্য কারুর সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গেই নিজের চ্যালেঞ্জ l প্রতিবার দর্শকের প্রতিক্রিয়ায় আরো আরো কাজের প্রেরণা পেয়েছে l ডাক পেতে পেতেই অনুষ্ঠান পরিচালনার সুযোগ আসে l স্বাধীনভাবে মৌলিক কাজের আনন্দ l নিজের স্ক্রিপ্টে গানের অনুষ্ঠান বা নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয় এবং প্রশংসিতও হয় l স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলে কিছুদিন সংবাদপাঠও করার সুযোগ হয়েছিল l বৃহত্তর সাংস্কৃতিক জগতে শুধুমাত্র নিজের তাগিদে কাজ করে সৃজনের আনন্দ… এ তৃপ্তি অন্তরকে আলোকিত করে বৈকি ! পাশাপাশি কিছু ছোট পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হতে হতে সাহিত্যক্ষেত্রেও খানিকটা পরিচিতি আসে l ফেসবুকে লিখতে লিখতেও বেশ কিছু ই -পত্রিকা ও ব্লগে লিখতে শুরু করে সে l বেশ কিছু গল্প সংকলন ও কবিতা সংকলন ছাড়াও একক কবিতার বই “হেমন্তের ঘ্রাণ” এবং একক গল্পের বই “আলোছায়ার কোলাজ” প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যে l তবু এখনও প্রচুর শেখা বাকি আছে তার… আজীবন শিক্ষার্থী হিসেবেই থাকতে চায় সে l আপাতত গানের অনুষ্ঠান, লেখার জগৎ নিয়ে সে নিজের একটুকরো ছোট্ট পৃথিবীতে বেশ আছে l জীবনের কাছে অনেককিছু চায়নি সে, তাই হয়ত জীবন তাকে উজাড় করে যা দিয়েছে অঞ্জলি পেতে গ্রহণ করেই সে খুশি, তৃপ্ত l জীবনের কাছে তার অনেক ঋণ l নিরুচ্চারে জীবনের উদ্দেশ্যে কান্তকবির ভাষায় শুধু এটুকুই বলতে চায় সে,
“আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাও নি
যা দিয়েছ তারই অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তো কিছু নাও নি…. “

©শর্মিষ্ঠা দত্ত

শর্মিষ্ঠা দত্ত
ফ্ল্যাট নং : ১০৬
বৃন্দাবন এনক্লেভ
সৃষ্টিনগর রোড
আসানসোল : ৭১৩৩০৫