সেভকেশ্বরী কালীবাড়িতে কালী পুজো

নিজস্ব প্রতিবেদন ঃ শিলিগুড়ি শহর থেকে সিকিম ও কালিম্পং যাওয়ার রাস্তায় সেভকের করোনেশন সেতুর কাছে তিস্তার ধারে রাস্তা থেকে ৩০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত সেভকেশ্বরী কালিবাড়ি। সেই সেভকেশ্বরী কালীবাড়িতে উঠতে হলে ১০৭টি সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে হয়।

সেই সেভকেশ্বরী কালিবাড়ির এখন সভাপতি হলেন প্রদ্যুৎ কুমার মিত্র আর সম্পাদক হলেন অচিন্ত্য বর্ধন। মন্দিরের ইনচার্জ স্বপন বসু। আর মন্দিরে পুরোহিত হিসেবে কাজ করছেন স্বপন ভাদুড়ি এবং নন্দ কিশোর গোস্বামী। তাদেরকে সহযোগিতার জন্য থাকছেন লক্ষণ ভাদুড়ি এবং তপন গাঙ্গুলী।
সেভকেশ্বরী কালীবাড়ির এই মন্দির খোলা হয় সকাল আটটায়। দুপুরে ১২টা ত্রিশ মিনিট থেকে একটা পর্যন্ত মন্দির বন্ধ থাকে ভোগের জন্য। তারপর আবার মন্দির খোলা হয় এবং তা খোলা থাকে সন্ধ্যে ছটা পর্যন্ত। মন্দিরে আসা ভক্তদের মধ্যে নিত্য ভোগের প্রসাদ বিতরণ করা হয়। তবে বিশেষ বিশেষ দিনে যেমন পয়লা বৈশাখ, ১৫ আগস্ট, পয়লা জানুয়ারিতে মন্দিরে ভক্তের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যায়। কালীপুজোর রাতে মন্দিরে ছয় হাজারেরও বেশি ভক্তের ভিড় হয়। সেবক পুলিশ ফাঁড়ির কর্মীরা ভিড় নিয়ন্ত্রণে পূর্ণ সহযোগিতা করেন বলে মন্দিরের ইনচার্জ স্বপন বসু জানিয়েছেন। দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে এই কালীবাড়িতে কলা, চাল কুমড়ো, আখ বলি হয়। মন্দিরের তরফে কোন পশু বলি হয় না। তবে কোন ভক্তের মানত থাকলে তাদের দাবি অনুযায়ী পাঁঠা বলি হয়। কিছু পাঠা উৎসর্গ করা হয়, তার সঙ্গে কিছু পায়রা উৎসর্গ হয়।
এবারে অমাবস্যা লাগছে ২৭ তারিখ দিন এগারোটা ৪৬ মিনিটে রবিবার। আর তা ছাড়বে সোমবার সকাল ৯টা ৩৯ মিনিটে। সেভক কালী বাড়ির পুরোহিতরা রাত দশটায় পুজো শেষ করার পর বলি শুরু হ। তারপর অঞ্জলি ও যজ্ঞ। এরপর প্রসাদ বিতরণ পুরোহিত স্বপন ভাদুড়ি জানালেন, ছয় ঘন্টার বেশি সময় ধরে পুজো হবে। দুজন পুরোহিত মিলে পুজো করবেন। মন্দির ইনচার্জ স্বপন বসু এবং পুরোহিত স্বপন ভাদুড়ি জানালেন, এই মন্দিরের বিশেষ বিশেষত্ব হল হোম যজ্ঞ। তার সঙ্গে পাঠা বলি তো আছেই। মন্দিরে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পুজোর সময় মায়ের ভোগে থাকে সাদা ভাত, খিচুড়ি, পাঁচ রকম ভাজা, একটি লাবড়া তরকারি, আলু ফুলকপির তরকারি, ফ্রায়েড রাইস, ছোলার ডাল, পায়েস, সুজি। বিশেষ ভোগ হয় বোয়াল মাছ দিয়ে। তার সঙ্গে দই মিষ্টি তো আছেই। তাছাড়া মাছ ভাজা চিড়া ভাজা রয়েছে কারণ দিয়েই উৎসর্গ করা হয় মাকে। স্বপনবাবুরা বলেন, এখানে মা খুব জাগ্রত। এত ভূমিকম্পের পরেও এই মন্দিরের কিছু হয়নি। বারবার ধস নামলেও এই মন্দির অক্ষতই রয়ে গিয়েছে। আবার অনেকে মানত করেও অনেক কিছু পেয়েছেন মায়ের কাছে। বিশাখাপত্তনমের ইঞ্জিনিয়ার জয়প্রকাশ গৌড় বেশ কিছুদিন আগে এই মন্দিরে এসেছিলেন। তার কোন সন্তান নেই। তিনি মায়ের কাছে সন্তানের জন্য মানত করে যান কিন্তু আশ্চর্য তার সন্তান হয়। এরপরই তিনি তার মানত অনুযায়ী এই মন্দিরের সিঁড়ি থেকে অন্য অনেক কাজ মার্বেল দিয়ে তৈরি করে দেন নিজের খরচায়। এভাবে মানত করে ফল মেলাতে কেউ টিনের ছাউনি, কেউ অন্য কিছু দিয়ে এই মন্দিরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছেন।
মন্দিরে রয়েছে পঞ্চমুন্ডির আসন। সেই আসন স্বপ্নে পাওয়া। নীরেন্দ্রনাথ সান্যাল নামে এক ব্যক্তি ছিলেন সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের কর্মী। বহুদিন আগে তাকে একবার এক সাধু এসে বলে যান, আমি চললাম– এখানে মা আছেন, পারলে তাকে দেখে রেখো। নীরেন্দ্রনাথবাবু এরপর স্বপ্ন দেখেন। আর স্বপ্ন দেখেই তিনি বর্তমান বেদির সামনে এসে দেখেন, একটি বেদি করা আছে, তার সামনে একটি ত্রিশূল, একটি জবা ফুল। তাছাড়া একটি বেলপাতা পড়ে রয়েছে। তা দেখবার পরপরই নীরেন্দ্রনাথবাবু মাকে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন। সেটা ছিল ১৯৫০ সাল। তখন সেই রাস্তা দিয়ে শুধু সেনাবাহিনীর গাড়িই বেশি যাতায়াত করত। সেনা জওয়ানা চীন সীমান্ত পাহারা দিতে যাওয়ার সময় এই মাকে প্রনাম করে যেতেন। নীরেন্দ্রনাথবাবুই সেখানে মাটির মূর্তি এনে প্রথম মায়ের পুজো শুরু করেন। চাকরি থেকে অবসর নিয়েও নিয়মিত মায়ের পুজো করেছেন। শিলিগুড়িতে তারাপদ পাল নামে এক ব্যক্তি আজও বেঁচে আছেন। তিনি নিয়মিত মায়ের পুজো করেন। মাকে নতুন বস্ত্র দিয়ে ভোগরাগ প্রদানের মাধ্যমে তিনি পুজো করেন। বর্তমান সেভকেশ্বরী কালী বাড়ির মার্বেল মূর্তি রাজস্থানের জয়পুর থেকে তিনি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলেন। বর্তমান মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয় ২০০৫ সালে। মা কালীর মূর্তি সেখানে শ্যামা কালী রুপে থাকলেও পুজো হয় দক্ষিণাকালী মতে। দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে মায়ের সামনে সেখানে রক্ত দিয়ে পুজো করার প্রথা চালু রয়েছে। মন্দির ইনচার্জ স্বপন বসু নিজেই তার বুক চিরে রক্তদান করেন। মায়ের সামনে ২০১৮ সালে মোট পাঁচজন এভাবে মাকে রক্তদান করেন। এর মধ্যে দুজন মহিলাও ছিলেন। বর্তমানে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এই মন্দিরের সৌন্দর্যায়নের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে রাজ্য পর্যটন দপ্তর