
কমলেশ গুহ (দ্য হিমালয়ান আই ইন্সটিটিউট)ঃএজ-রিলেটেড ওয়েট ম্যাকুলার ডিজেনারেশন (ওয়েট এএমডি) একটি বিরল রোগ । এই রোগে রেটিনার নীচে অস্বাভাবিক রক্তনালী সৃষ্টি হয়। এই রক্তবাহী নালী থেকে রক্ত বা তরল পদার্থ বার হয়ে রেটিনার ম্যাকুলা অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ম্যাকুলা যদি ঠিকমত কাজ না করে, তাহলে বই-কাগজ পড়তে গেলে বা কোনও কিছু দেখার সময়ে গোল কালো ছায়া বা কালো পর্দা এসে পড়ে চোখের সামনে। সোজা লাইন এঁকেবেঁকে যায়, টিভির পর্দার ছবি রংহীন মনে হয়। দিনে-দিনে দৃষ্টিশক্তি কমতে থাকে, এমনকী হঠাৎ করে দৃষ্টিশক্তি চলে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বাইক বা গাড়ি চালানো অত্যন্ত কঠিন এবং বিপজ্জনক।
বাইক অ্যাম্বুলেন্স দাদা “পদ্মশ্রী” করিমুল হক এই বিরল রেটিনার রোগে ভুগছেন। রক্তক্ষরণের কারণে তার বাম চোখের দৃষ্টি অনেকটাই কমে গেছে। অথচ “পদ্মশ্রী” তার বাইক অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া জীবন কল্পনা করতে পারেন না। গত 15 বছর ধরে গ্রামের অসুস্থ মানুষদেরকে বিনা খরচে তার বাইকে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছেন তিনি। আশেপাশের কোন গ্রামে কারো কোন সমস্যা হলেই প্রথম ফোন আসে করিমূলের কাছে। রাত-বিরেতে ছুটে যান মুমূর্ষু রোগীর পাশে তার বাইক অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে। একটা ওড়না বা কাপড়ের টুকরো দিয়ে নিজের পিঠের সাথে বেধে নিয়ে গিয়েছেন হাসপাতালে অজস্র মানুষকে। বিপদের বন্ধু হিসেবেই পরিচিত জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার মহকুমার ক্রান্তি-রাজাডাঙ্গা এলাকার করিমূল হক। তাঁর এই নিঃস্বার্থ কাজ এখন কেবলমাত্র মাল ব্লক নয় গোটা দেশ তথা বিশ্বের কাছে নজিরবিহীন। আজীবন এভাবেই অ্যাম্বুল্যান্স দাদা হিসেবেই থাকতে চান তিনি। বাইক অ্যাম্বুলেন্স দাদার জন্য বাড়িতে বসে থাকা অত্যন্ত অসহনীয় । যিনি লকডাউনের সময়ও বাড়িতে থাকতে পারেননি আজ চোখের সমস্যার কারণে তিনি অনেকটাই নিরুপায়। ডাক্তারের নির্দেশ, এই পরিস্থিতিতে গাড়ি চালানো যাবে না।
চোখের এই গুরুতর সমস্যার একটি প্রধান কারণ চোখের পরীক্ষায় দেরী। যিনি সবসময় অন্যের স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে চিন্তিত, তিনি নিজের চিকিৎসার জন্য সময় বের করতে পারে না। অথচ এই ধরনের রোগে সমস্যাগুলো শুরু হলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কিন্তু মুশকিল হল, অধিকাংশ রোগীই প্রথমে সমস্যাটা ধরতে পারেন না বা উপসর্গগুলো উপেক্ষা করেন! সাধারণত দুটো চোখে একসঙ্গে সমস্যা শুরু হয় না। তাই এক চোখে ঠিক দেখেন বলে অন্য চোখটি যে দুর্বল হচ্ছে তা টের পান না। করিমুল হক গত দুই বছর ধরে এই রোগে ভুগছেন। এর আগেও তার বাম চোখে রক্তপাত হয়েছিল। ছয়টি অ্যান্টি-ভেজিএফ ইনজেকশন নেওয়ার পর তিনি তার চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। কয়েক মাস সুস্থ থাকার পর এখন আবার তার চোখে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

ম্যাকুলার ডিজেনারেশন অনেক কারণে হতে পারে। অতিরিক্ত সূর্যের আলট্রাভায়োলেট রশ্মির জন্যও রেটিনায় এই ধরনের ক্ষতি হয়। এটা তাঁদের হয়, যাঁরা অনেকটা সময়ে সরাসরি রোদের মধ্যে খালি চোখে কাজ করেন। অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছে ধূমপান বা জেনেটিক কারণ ইত্যাদি।
এএমডি সমস্যা সাধারণত শুরু হয় পঞ্চাশের পর থেকে। এরও দুটো ভাগ আছে। ড্রাই টাইপ, ওয়েট টাইপ অর্থাৎ শুকনো ও আর্দ্র। এএমডির আর্দ্র ফর্ম (একে এক্সিউডেটিভ বলা হয়) কম সাধারণ (এএমডি আক্রান্ত 10 জনের মধ্যে একজনের মধ্যে ঘটে), তবে এটি আরও গুরুতর। এক্ষেত্রে চোখের ভিট্রিয়াস জেলে অ্যান্টি-ভাস্কুলার এন্ডোথেলিয়াল গ্রোথ ফ্যাক্টর (এন্টি-ভিইজিএফ) এজেন্টের ইনজেকশন দেওয়া হয়। সমস্ত রক্ত এবং তরল শুকিয়ে যাওয়া এবং অস্বাভাবিক রক্তনালী অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়।
যেহেতু এএমডি এর কোন প্রতিকার নেই, তাই প্রতিরোধ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ক্ষতিকারক সূর্যালোক থেকে চোখ রক্ষা করতে বাইরে UV ফিল্টার সহ সানগ্লাস ব্যবহার করা, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন সমৃদ্ধ সবুজ ও শাক-সবজি বা ভিটামিন/ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা এবং নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষা করানো।
হিমালয়ান আই ইনস্টিটিউটের রেটিনা বিশেষজ্ঞ ডাঃ সঙ্গীতা ডি. গোস্বামী করিমুল হককে তিনটি অ্যান্টি-ভেজিএফ ইনজেকশন নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রথম ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে 21শে জানুয়ারী 2023 তারিখে। এই মুহূর্তে আমাদের একটাই লক্ষ্য, আর তা হলো পদ্মশ্রী করিমুল হকের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনা যাতে বাইক অ্যাম্বুলেন্স দাদা তার সমাজসেবামূলক কাজ সক্রিয়ভাবে চালিয়ে যেতে পারেন। এই প্রচেষ্টায় সকলের সহযোগিতা এবং শুভকামনা একান্ত কাম্য।