অনন্য বাঙালি প্রণব মুখোপাধ্যায়

সুলেখা সরকারঃরাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণের পর প্রবল হর্ষধ্বনির মধ্যে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার কর্তব্য সম্পাদনের সময় আমি নিরপেক্ষ থাকব এবং চাইবো যে এই দেশের দরিদ্রতম মানুষটিও যেন নিশ্চিতভাবে অনুভব করতে পারেন যে তিনিও এই মহান দেশের অংশ।’

পল্টু থেকে প্রণব মুখার্জি হয়ে ওঠা, ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি হয়ে ওঠা সেটা সাধারণ ঘটনা ছিল না। তার সুভাষণ, সুবিচার-বিবেচনা, পরিস্থিতির মোকাবিলা ও তার বিশ্লেষণ, আত্মপ্রত্যয় সর্বোপরি দলের প্রতি আনুগত্য তাকে সর্বভারতীয় রাজনীতির একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তিনি প্রমাণ করেছিলেন রাষ্ট্রনায়ক হতে গেলে চাণক্যগত কূটনীতিবোধ প্রয়োজন। স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালি বিপ্লবীদের ভূমিকা সম্পর্কে আমরা পড়েছি। ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে বাঙ্গালীদের ভূমিকা দেখেছি কিন্তু একজন বাঙালি শেষ পর্যন্ত ভারতবর্ষের সাংবিধানিক শীর্ষ পদে নিজের স্থান দখল করে নেবেন এটা আশ্চর্যের। বিস্ময়ের ।

ভারতীয় সংবিধান সম্পর্কে তিনি জানতেন, রাষ্ট্রপতির ভূমিকা মূলত আলংকারিক। বিচারপতি শ্রী এস এইচ কাপাডিয়া তাকে রাষ্ট্রপতির পদে শপথ গ্রহণ করিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি পদে থাকাকালীন তিনি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রতির দপ্তরের গৌরব পূর্ণ মর্যাদায় রক্ষা করেছিলেন এবং তার পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে সংবিধান ও আইনের রক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন। পরবর্তীকালে ২০১৯ নভেম্বরে যখন দিল্লিতে তার অফিস ১০ মার্গে তার সাথে দেখা করার অনুমতি পাই তখন বদরুদ্দীন উমর-এর একটি উক্তি বারবার মনে পড়ছিল। ‘

‘বাংলাদেশের যেকোনো অংশে যারা মোটামুটি স্থায়ীভাবে বসবাস করে, বাংলা ভাষায় কথা বলে, বাংলাদেশের আর্থিক জীবনে অংশগ্রহণ করে এবং বাংলা ঐতিহ্য নিজেদের ঐতিহ্য বলে মনে করে মূলত তারাই বাঙালি। যদিও সেটা গত শতকের ছয় দশকের ভাবনা। এখন বিশ্বায়নের সাথে পরিস্থিতির বদল, ভাবনা, মানসিকতার বদল হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, লক্ষ্য স্থির হলে ভ্রষ্ট হওয়ার ভয় কম । টেকনিক্যালি চলা প্রয়োজন। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি অথচ এতটা সাধারণভাবে কথা বলছিলেন আমারও যেন সাহস বেড়ে যাচ্ছিল। অনুমতি নিয়েছিলাম যতবার দিল্লিতে আসবো ততবারই উনার সাথে দেখা করব। কিন্তু আজ বড় দুঃখের দিন। সেই ইচ্ছে আর কোনদিনই পূর্ণ হবে না। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ, সর্বভারতীয় ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম একজন বাঙ্গালী বাংলা ভাষায় কথা বলছেন। ধুতি-পাঞ্জাবির মধ্যে বাঙালিয়ানা বহন করছেন। তার হাসিতে বাঙালির স্বতস্ফূর্ততা । বাঙালি বিপ্লবীর উত্তরসূরী । রাষ্ট্রনায়ক। তিনি সার্থক ।সার্থক রাষ্ট্রনেতা।