লেখালেখির সঙ্গে সঙ্গীত দিয়ে বহুমুখী প্রতিভার উদাহরণ বৈশাখী

শিল্পী পালিত ঃ আজ শিলিগুড়ির বৈশাখী বোসরায় লিখেছেন আত্মকথায়। শিক্ষিকা বৈশাখীদেবীর বিভিন্ন ব্যতিক্রমী, সৃজন কাজের কথা শুনুন —

বীণাপাণির আরাধনায় বীণাপাণির(শিল্পী পালিত) সাথে দেখা, গানবাজনার আসরে। তাঁর অনুরোধ, আত্মকথা লিখতে হবে। চমকে উঠেছিলাম।আমার মতো সাধারণ মেয়েকে অসাধারণ প্রস্তাব !—আমার আত্মকথা কে পড়বে বলতো? বীণাপাণি বলল,__দেখ অসাধারণদের কথা তো সবাই লেখে, সবাই জানে। আমরা সাধারণদের মধ্যেই প্রতিভা খুঁজি, তাদের তুলে ধরার চেষ্টা করি আমাদের পত্রিকার মাধ্যমে। আর তোমার মধ্যে কী আছে,তা একটু আগে আমরা সবাই শুনেছি। অগত্যা, কি আর করা! দুরুদুরু বুকে আত্মকথা লিখতে বসলাম। আপনাদের ভালো লাগলে, সেটাই হবে আমার পরম পাওয়া।
আমি আসলে প্রবাসী বাঙালি, ভাগলপুরের মেয়ে। অশোক কুমার, কিশোর কুমার থেকে নিয়ে শরৎচন্দ্র ,বনফুল, বিভূতিভূষণ,দিবেন্দু পালিত, সুচিত্রা ভট্টাচার্য ছাড়াও কত যে নামি-দামি লোকের নাম জড়িয়ে আছে, বিহারের এই বাঙালি অধ্যুষিত সাংস্কৃতিক পীঠস্থানটির সঙ্গে!আমি তো সেই ভাগলপুরেরই মেয়ে,তাই স্বাভাবিকভাবে ছোটবেলা থেকেই নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলাম,তা সে বাঙালি সমিতির রবীন্দ্র-জন্মজয়ন্তী পালন হোক অথবা কলেজে বাইশে শ্রাবণ । তাছাড়া আমাদের বাড়িতেও ছিল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল । ঠাকুরদা ছিলেন খ্যাতনামা ডাক্তার। বাড়ির দুর্গাপূজাকে ঘিরেই ছিল আত্মীয়-বন্ধু সমাগম , সংস্কৃতচর্চা। মহালয়ার_”বাজলো তোমার আলোর বেণু–“সেই শৈশবেই মনে অনুরণন জাগাতো! বাবা-মা, কাকু-কাকিমা,পিসিরা অনেকেই খুব ভালো গাইতেন,নাচতেন, অভিনয় করতেন।ঠাকুরদালানে বাড়ির বাচ্চা থেকে বুড়োর ধুনুচি নাচ ছাড়াও একাদশীর দিন বিশাল ছাদে ম্যারাপ বেঁধে গান-নাচ-নাটকের আসর বসতো।তবে শুধু দুর্গাপূজায় গানবাজনা হতো এমন নয়। আসলে আমরা ছিলাম একান্নবর্তী পরিবার। সারাবছরই বাড়িতে নানা অনুষ্ঠান পালন হতো,তা সে বিবেকানন্দের জন্মদিন হোক অথবা দাদুর জন্মদিন,আমরা খুড়তুতো- জ্যেঠতুতো ভাইবোনেরা নাচ-গান সহযোগে তাতে মেতে উঠতাম।আর মাসের দুটি রবিবার বাড়িতে পাঠচক্রের আসর বসতো,তাতেও গান গাওয়া চাই-ই চাই।‌তাই জ্ঞান হওয়া ইস্তকই দেখেছি, ইচ্ছে করলেই আমি গাইতে পারি।
তবে, অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীনই প্রথম প্রথাগত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের স্বল্পদিনের তালিম শুরু হয়,কিরানা ঘরানার পণ্ডিত হনুমান শরণ মিশ্রাজীর কাছে।
আশৈশব রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে আমার প্রেম। বিবাহ সূত্রে শিলিগুড়ি এসে ,এই রবীন্দ্র সঙ্গীতের রসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হওয়ার চেষ্টা শুরু করি, স্বর্গীয় গুরু দুলাল সুর চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে। সেইসময় বেশ কিছু প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে পুরস্কৃতও হই। পরবর্তীকালে সুচিত্রা মিত্রের স্নেহধন্য শিষ্য, গুরু মিন্টু রায়ের কাছে বেশ কয়েকবছর রবীন্দ্র সঙ্গীত শিক্ষা চলে। আমার অসীম সৌভাগ্য,এইসময়ই ‘২০০৪’-এ তাঁর সঙ্গীত বিদ্যালয় ,’গীতায়ন’-এর, রজত জয়ন্তী বর্ষে কিংবদন্তি রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্রের সান্নিধ্য লাভ করি ও দীনবন্ধু মঞ্চ ও পরবর্তীকালে বসুন্ধরায় অনুষ্ঠান করার সুযোগ পাই।
এরপর কিছুদিন শ্রদ্ধেয় স্বপন দের কাছে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও আধুনিক গান শেখা ও নানা অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা লাভ।
আমার সঙ্গীত জীবনে অনেক গুরুর সান্নিধ্য লাভ করেছি, ভিন্ন ভিন্ন ধারায় সমৃদ্ধ হয়েছি। আসলে শেখার তো কোনও শেষ নেই। যতদিন বাঁচি, ততদিন শিখি।সবজানা মানুষটাও যে বলেন__”বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি!”
জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ও পণ্ডিত জয়ন্ত বসুর সুযোগ্য শিষ্য, অভিমান রায়ের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও আধুনিক গান শিখেছি। গলাটাকে আসলে ভাতের মতো করতে হয়,যাতে যা মাখা হবে তারই স্বাদ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের গান গাইলে তার স্বাদ, আধুনিক গাইলে তার স্বাদ অথবা লোকগান বা যা কিছুই গাই না কেন তার স্বাদ পেতে গলাকে তৈরি করতে হয়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও নিয়মিত রেওয়াজই পারে গলাকে এই জায়গায় নিয়ে আসতে। আসলে তিন-চার মিনিটের একটা গানকে সুন্দরভাবে গাওয়ার পেছনে বছরের পর বছরের সাধনা থাকে। বলতে দ্বিধা নেই, সেই জায়গাটা আমি বুঝেছি গুরু অভিমান রায়ের কাছে গান শিখতে এসে। আমার সব গুরুদের উৎসর্গ করেই আমার এই লেখা।
এখন পাঞ্চালি চক্রবর্তী, নির্মল গাঙ্গুলি, সুকুমার ঘোষালের মতো গুণীজনেদের সান্নিধ্যে ও সহযোগিতায় একটি গ্রুপে যুক্ত থেকে গান বাজনা করছি। আশাকরি আপনাদের আশীর্বাদে আগামী দিনে গান গেয়ে আপনাদের আনন্দ দিতে পারব।আর নিজের আনন্দ তো আছেই! আসলে শিল্পচর্চার প্রধান উদ্দেশ্যই যে রসসৃষ্টি, আনন্দ! আমিও যে সেই স্থির লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই!
স্থানীয় টি.ভি চ্যানেল ইত্যাদির জন্য বেশ কিছু বিজ্ঞাপনের কাজ করেছি। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো,_আই.আর.সি.টি.সি-র ‘জন আহার’-এর বিজ্ঞাপন,হিন্দী ও ইংরেজীতে,যেটি এন.জে.পি স্টেশনে শোনা যায়।
অন্যদিকে, স্কুলে নিম্নবিত্ত পরিবারের বাচ্চাদের,যারা গানবাজনার পরিবেশেই নেই, তাদের গান শেখাতে পেরে যে আনন্দ পেয়েছি ,তা নিজে গান গাওয়ার আনন্দের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।এখন,__’গানই আমার জীবন ওগো,গানই আমার কাঁদা-হাসা।’
এবার আসা যাক লেখালেখির কথায়। শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, বনফুল, সুচিত্রা ভট্টাচার্যের দেশের মানুষ আমি, একটু আধটু লিখবো না,তা কি হয়!তবে ওই একটু আধটু-ই। আসলে ব্যস্ততার জন্য লেখালেখিটা ঠিকঠাক হচ্ছে না। তারমধ্যেও টুকটাক গল্প -কবিতা বেড়িয়েছে ‘খবরের ঘণ্টা’ ছাড়াও বেশ কিছু পত্র- পত্রিকায়। বিগত দুই বছর, কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় আমার লেখা গল্প প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম বছর, ‘মহুয়া প্রকাশনী’ থেকে,__’বর্ডার পারের গল্প’ ও গতবছর ‘আনন্দ পাবলিকেশন্স’ থেকে,__’রাখী ফিরে এলো’। এছাড়া বেশ কিছু অনুবাদ কর্মও করেছি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আশাপূর্ণা দেবীর ‘ইজ্জত’গল্পটির হিন্দী নাট্যানুবাদ ও হরিশঙ্কর পরসাই-য়ের হিন্দী নাটক,’ নর্ক সে বোল রহা হুঁ’-এর বাংলা অনুবাদ,’নরক থেকে বলছি’। আমার সৌভাগ্য ,অভিজিৎ দে এই নাটকটি শিলিগুড়ি ও কলকাতায় একক অভিনয় করেছে, প্রশংসিতও হয়েছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা__
___’রাতের পর রাত যায়, দিনের পর দিন,
শব্দের পর শব্দ আসে,আসে চিন্তা নিশিদিন—
দিন যে ফুরালো,রাত যে কত নষ্ট হলো সুখে, শব্দের পর শব্দ এলো, ভাষা এলোনা মুখে!
তেমনি জীবনের ধন যে ফুরালো, এলোমেলো নানা কাজে—
মৃত্যু শিয়রে দেখেছি এবার, বুকে দুন্দুভি বাজে!
বাঁচাও আমায়!বাঁচাও ওগো!কোথায় কে আছো ভাই!
কিছু চাই নে, আমি যে শুধু অমৃতকেই চাই!’
—-বৈশাখী।