সঙ্গীতের পরিমন্ডলেই বড় হয়েছেন জলপাইগুড়ির কৃষ্ণা সেনগুপ্ত

শিল্পী পালিত ঃ জলপাইগুড়ির পান্ডাপাড়ার কৃষ্ণাা সেনগুপ্ত জানাচ্ছেন তাঁর আত্মকথা —

“আমি অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের এক সাধারণ মেয়ে। আমার সাংস্কৃতিক জীবন তুলে ধরবার মতো বর্ণাঢ্য জীবন আমার নয়। তবুও আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন বীণাপাণি শিল্পীর অনুরোধে আজ কলম ধরতে বাধ্য হয়েছি নিজের সম্পর্কে কিছু লিখবার জন্যে।

১৯৪৯ সালের ১৪ ই জুন এক গুপ্ত ভায়া পরিবারে আমার জন্ম। আমার বাবার নাম মনোরঞ্জন গুপ্ত ভায়া, মা সুধা গুপ্ত ভায়া। মোট চার ভাই ও পাঁচ বোন ছিলাম আমরা। আমার সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে কিছু বলতে হলে আমার মা ও বাবার কথা বলতেই হয়। আমার বাবা ও মা দুজনেই ছিলেন খুব গুণী মানুষ। ছোট থেকেই আমরা ভাই বোনেরা এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে বড় হয়েছি। আমাদের মা ছিলেন সরল সাদাসিধে এক মমতাময়ী মা। উনি বিয়ের আগে সেই যুগে কলকাতার বেথুন স্কুল-কলেজে পড়াশুনা করেছিলেন। আজীবন পরম নিষ্ঠার সঙ্গে শিক্ষকতা করে গেছেন। মহান সঙ্গীত শিল্পী মান্না দে’র কাকা সেকালের বিখ্যাত গায়ক কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র কাছে উনি সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেছিলেন। আমাদের ভাই বোনদের সাধ্যমত গানবাজনা ও লেখাপড়া শিখিয়েছেন। আমাদের বাবা অতীতে স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং দেশের জন্য বেশ কয়েকবার কারাবরণ করেছিলেন। অতীতে তিনি নাটক করতেন, “শাজাহান” নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে পুরস্কারও পেয়েছিলেন।শিশু বয়সে সে যুগের অমর শিল্পী রজনীকান্ত সেনের কোলে বসে গান শিখেছিলেন। তবলা বাজাতেও পারতেন। আমাদের ছোটবেলায় প্রত্যেক রবিবার সকালে বসতো গানবাজনার আসর,সন্ধ্যে বেলায় হতো কীর্তন। বাবার কীর্তনের দল ছিল। এরকম একটা পরিবারে জন্মানো আমাদের কাছে ছিল বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু আজ বলতে দ্বিধা নেই, আমরা হয়তো তাঁদের যোগ্য সন্তান হয়ে উঠতে পারি নি।

মায়ের কাছে প্রাথমিক সঙ্গীত শিক্ষা লাভের পর, আমাদের ছোটবেলায় আমি ও আমার দুই দিদি, মেজদি ও ছোড়দি, গানের স্কুলে যেতাম গান শিখতে। আমার ছোড়দি ভারতী সেনগুপ্তের মধ্যে ছিল একাধারে অনেক গুণ। ভালো গান গাইতে পারার সাথে সাথে বেহালা, সেতার প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রও আয়ত্ত করেছিল ভালোভাবেই। ছোড়দি জলপাইগুড়ির তদানীন্তন নাম করা সেতার-বাদক জাম্বা পালের কাছে সেতার শিখতো। প্রতি সপ্তাহে আমিও যেতাম ওর সাথে সেতারের স্কুলে। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ছে, যেটা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। আমি তখন Govt. Girl’s School -এ Class Seven – পড়ি। সেতারের স্কুলে গিয়ে দেখতাম সাইজে একটু ছোট সেতার রাখা আছে। আমি একদৃষ্টে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সেতারের শিক্ষক সেটা লক্ষ্য করে একদিন বললেন, “তুমি এই সেতারে সেতার বাজানো শিখবে ?” আমার মনের কথা উনি কি করে বুঝলেন জানি না – আমি সানন্দে বলে উঠলাম, “হ্যাঁ, আমি শিখবো। সেই থেকে আমারও শুরু হলো সেতার শেখা। আমি গানের জন্য স্কুলের বন্ধুদের কাছে জনপ্রিয় ছিলাম। ক্লাসে কোনও কারণে শিক্ষিকা না এলে বন্ধুদের অনুরোধে আমাকে গান গাইতে হতো। এরপরে আমি সেতার শিখি এ কথা চাউর হতেই স্কুলের বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমাকে সেতারে কবিগুরুর “আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা” গানটির সুর বাজাতে হয়েছিল। আমার দু’পাশে দুজন ছাত্রীও গীটারে এই গানটির সুর আমার সাথে বাজিয়েছিল। এই ঘটনা স্কুলে আমাকে রাতারাতি বিখ্যাত করে দিয়েছিল।

আমার আরেক দিদি, তপতী গুপ্ত ভায়া অত্যন্ত ভালো গান গাইত। দুর্ভাগ্যবশত সে আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। এই মেজদির তত্ত্বাবধানে ছোটবেলায় প্রতি বছর পাড়ার সব মেয়েদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেমন নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্য এসব হতো। মেজদি নিজেই গ্রন্থনা লিখত, তার সাথে মিলিয়ে গান নির্বাচন করত। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনে গ্রন্থনা লিখে স্বদেশী গান গাওয়া হতো। আমাদের বাড়িতেই চলতো এ সব অনুষ্ঠানের রিহার্সাল। সে সব দিনের মধুর স্মৃতি আজও মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করে।

আমার উপরের দাদা অর্থাৎ ছোড়দা তিলক গুপ্ত ভায়া উত্তর বঙ্গের একজন বিশিষ্ট কবি তথা সাহিত্যিক। তাঁর লেখা কবিতা ও গল্প সাহিত্য জগতে যথেষ্ট সমাদর পেয়েছে। বর্তমানে তিনি কয়েক মাস যাবৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে প্রায় শয্যাশায়ী। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে আবার স্বমহিমায় তাঁর কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসুন। তাঁর মেয়ে নিবেদিতাও ভালো গান গায় এবং সাংস্কৃতিক জগতের সাথে যুক্ত। আমার ছোট ভাই আশীষ গুপ্ত ভায়া জলপাইগুড়ির সঙ্গীত জগতে একটি পরিচিত নাম। অতীতে অনেক ফাংশনে গান গেয়ে সুনাম অর্জন করেছে। পরম নিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গীত শিক্ষকতাও করেছে। তাঁর দুই মেয়ে দেবস্মিতা ও দেবাঙগনাও ভালো গান গায়। আমার বড়দির ছেলে দেবাশীষ দাশগুপ্তও সঙ্গীত জগতের সাথে যুক্ত। আমার ছোড়দি ভারতী কলি সেনগুপ্তের মেয়ে সোহিনীও খুব ভালো গান গায়। ও বর্তমানে ডাক্তারি পেশায় যুক্ত থাকায় আর সময় দিতে পারে না। এদের প্রত্যেকের জীবন আমার সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। সেজন্য এদের কথা একটু না বলে পারলাম না।

সবাইকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে এখানেই আমার সামান্য সাংস্কৃতিক জীবনের ইতি টানছি। বর্তমানে আমাদের দেশ তথা সমগ্র পৃথিবীর দুর্যোগ কেটে গিয়ে নতুন সূর্য উঠুক, যে সূর্যের আলোয় আবার ঝলমল করে উঠবে পৃথিবী !

আমার বাবা-মা, কাকা- জ্যাঠাদের আশীর্বাদেই ১৯৭১ সালে এক আদর্শ বনেদী সেনগুপ্ত পরিবারে আমার বিয়ে হয়েছিল। আমার স্বামী বীরেশ্বর সেনগুপ্ত ছিলেন দেবতুল্য মানুষ। আমার একই ছেলে সম্রাট সেনগুপ্ত, পুত্রবধূ অঞ্জনা সেনগুপ্ত এবং একমাত্র নাতনী সমৃদ্ধি সেনগুপ্তকে নিয়ে আজ আমার সুখের সংসার। এদের নিয়েই আমি সুখে-শান্তিতে বাকী জীবনটা ঈশ্বরের শ্রীচরণে সমর্পণ করে অতিবাহিত করতে চাই।

কৃষ্ণাা সেনগুপ্ত
পান্ডা পাড়া, জলপাইগুড়ি।