শিল্পী পালিত ঃ গড়িয়ার বাঁশদ্রোনী থেকে পূবালী স্বাধীনতা দিবসের ভাবনায় লিখেছেন অন্যরকম এই লেখা, অন্যরকম গল্প। দেশকে শ্রদ্ধা জানানোর গল্প–
দেশের মাটি
বাবাকে অর্জুন আর দেখতে পায়না। তবু ওর ভালো মনে পড়ে, সেই ছোটোবেলায় মাঝে মাঝে বাড়ি আসতো বাবা,আর ওর জন্য নিয়ে আসতো একঝুড়ি গল্প।বরফের দেশের গল্প, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জমে গিয়েও কেমন করে রাক্ষসদের হাত থেকে মা-কে বাঁচিয়েছে বাবা,সেই গল্প।প্রখর রোদ্দুরে নিজের কষ্টকে পরোয়া না করে খোক্কসদের কবল থেকে কেমন করে মা-কে নিরাপদ রেখেছে,সেই গল্প! আরও কত গল্প বলতো বাবা! জামা খুলে যখন স্নান করতো,একদিন ও দেখতে পেয়েছিল বাবার হাতে একটা বিচ্ছিরি দাগ।বাবা বলেছিল এটা গর্বের দাগ।মা-কে কামড়াতে আসছিল রাক্ষসের দল তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে বাবা,এটা তাদের কামড়ের দাগ। সেই বাবা একদিন বাক্সবন্দি হয়ে বাড়ি এসেছিল,তার ওপর তেরঙ্গা কাপড় দিয়ে ঢাকা। বাবা শুয়েছিল, একটাও কথা বলেনি ওর সঙ্গে, মাকে সবাই ধরে রেখেছিল। মা একবারই মাত্র কেঁদে উঠেছিল,তারপর ওর হাতধরে বলেছিল বাবাকে প্রণাম করতে।বাবা নাকি সেই মা-কে বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হয়েছে! ও অবাক হয়ে বলেছিল বাবা আর ঘরে আসবেনা? সবাই যে বলছে বাবা মরে গেছে। মরে যাওয়া মানে কি মা? মা ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল তোমার বাবা মরেননি,শহীদ হয়েছেন।শহীদরা মরে না। তারপর ওরা বাবাকে নিয়ে চলে গেল। মা ঘরে এসে বাবার মস্ত ফটোটা দেওয়াল থেকে নামিয়ে তার সামনে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
ও শুধু জিজ্ঞেস করেছিল আমার ঠাকুমা তো বাবার মা,তাকে বাঁচাতে গিয়েই কি বাবা শহীদ হয়ে ছবিতে ঢুকে গেল? মা ওকে বলেছিল,না ঠাকুমা নন। তিনি তো কবেই আকাশের তারা হয়ে গেছেন। কাল তোমাকে ওই মায়ের সঙ্গে দেখা করাবো,তিনি আমাদের সবার মা!
পরদিন সকালে মা অর্জুনকে নিয়ে বাগানে গেলেন,বাবা বাড়ি এলেই মায়ের লাগানো গোলাপ গাছগুলোকে খুব যত্ন করতো। গোড়ার মাটিগুলো খুরপি দিয়ে খুঁড়ে দিয়ে বলতো,গাছেরা নিঃশ্বাস নেবে।
মা গোলাপ গাছের গোড়ায় বসে মুঠোভরে সেই ঝুরো-মাটি খানিকটা নিয়ে ওকে বললেন,এই দেখো,এই মাটি হলো আমাদের সকলের মা।দেশের মাটি।তোমার বাবা এই মা-কে রক্ষা করতে গিয়েই শহীদ হয়ে এই মাটি মায়ের কোলে মিলিয়ে গেছেন।এই মাটিকে কক্ষণো অসম্মান করবে না,এর সম্মান সব সময় রাখতে হয়।
কিছুদিন পরথেকে ও যখন স্কুলে যেতে আরম্ভ করলো তখন থেকেই মা ওকে নানান গান শেখাতেন। তারমধ্যে একটা গান ওর বিশেষ ভালো লাগতো,
” ও আমার দেশের মাটি
তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা”…
ওর মাও এখন একটা স্কুলে পড়ান আর সন্ধ্যেবেলা পড়াশোনা করিয়ে ওকে দেশের গান শোনান।
অর্জুন এখন বেশ বড়ো।ক্লাস ফোরে পড়ে।
আজ স্বাধীনতা দিবস।স্কুলে পতাকা উত্তোলনের পর অনেক অনুষ্ঠান হবে।বাচ্চারা গান গাইবে,কবিতা বলবে।খুব আনন্দ হচ্ছে ওর।এখন ও জানে বাবার কফিনকে যে তেরঙ্গা কাপড়টা চাপা দেওয়া হয়েছিল ওটা ভারতের জাতীয় পতাকা। দেশমাতৃকার বসন।
স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা ওদের দুপাশে দুটো সারিতে দাঁড় করিয়ে দিলেন।মাঝখানে অস্থায়ী একটা ইট আর মাটির ছোটো মঞ্চে ফুল বাঁধা জাতীয় পতাকা লাঠির আগায় বাঁধা। শহরের কাউন্সিলর এসে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা করবেন।অর্জুন উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছিলনা।
অবশেষে তিনি এলেন।ধীরে ধীরে পতাকার দিকে এগিয়ে গেলেন।পতাকার নিচে অস্থায়ী মঞ্চের তলায় কিছুটা মাটি পড়েছিল।একি!! কাউন্সিলারের পায়ে জুতো কেন?
অর্জুন প্রমাদ গুনছিল দেশমাতৃকার গায়ে তাঁর জুতো স্পর্শ করবেনা তো। কিন্তু ঠিক তাই হতে চলল,অর্জুন আর থাকতে পারলো না,এক ডাইভ দিয়ে ওই কাউন্সিলর এর পায়ের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ল।তার হাতে তখন একমুঠো মাটি। এই নড়াচড়ার ফলে বাঁশে বাঁধা পতাকা হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল,অর্জুন আর এক হাতে সেই ডাণ্ডা ধরে উঠে দাঁড়াল। তার মুখ কেটে রক্ত ঝরছে। সবাই অবাক। অর্জুন কাউন্সিলরকে বলল আমাকে ক্ষমা করে দিন স্যার,আপনার জুতো আমার দেশমাতৃকার গায়ে লেগে আজকের দিনে মায়ের অপমান হতে যাচ্ছিল। বলে মুঠোভরা মাটি মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলল,আমি কিন্তু দেশের পতাকার মাথা নিচু হতে দিইনি স্যার।আসুন জুতো খুলে মাটিতে পা না ঠেকিয়ে পতাকা উত্তোলন করুন। প্রধান শিক্ষক মরমে মরে গিয়ে ভয়ে ভয়ে কাউন্সিলরকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কাউন্সিলর বললেন না,এই বাচ্চা ছেলেটা আজ আমার চোখ খুলে দিয়েছে। অনুষ্ঠানের শেষে এরজন্য আমি ওকে পুরস্কৃত করব। পতাকা উত্তোলনের পর একে একে সবাই গান করল,কবিতা বলল, সবশেষে অর্জুন চোখবন্ধ করে গাইতে লাগল,
“ও আমার দেশের মাটি
তোমার পরে ঠেকাই মাথা”…
ওর দু’চোখে জলের ধারা।
কাউন্সিলর প্রধান শিক্ষককে বললেন,ওইটুকু ছেলে গানটার মানে বুঝে কত গভীরে প্রবেশ করেছে। ও প্রকৃতই দেশমাতৃকাকে শ্রদ্ধা করে এবং দেশকে যথার্থ ভালোবাসে।
অনুষ্ঠানের শেষে কাউন্সিলর অর্জুনের গলায় ভারতের লোগো দেওয়া একটা মেডেল পরিয়ে দিলেন।
মেডেলটা দেখতে দেখতে অর্জুন ভাবতে লাগলো বাবা কি খুশি হচ্ছে!!
©পূবালী
ঠিকানা :
শুভদা অ্যাপার্টমেন্ট,ফ্ল্যাট নং কে-5, পি-125 ঊষাপার্ক
থানা: বাঁশদ্রোনী
পোস্ট অফিস: গড়িয়া
পিনকোড: 700084