অহিংসা ও নৈতিকতার বৃদ্ধি দিয়েই করোনার মতো যুদ্ধ জয় করার পরামর্শ দার্শনিকের

বাপি ঘোষঃ একদিকে নৈতিকতা বৃদ্ধি আর একদিকে অহিংসা এই দুইয়ের মাধ্যমে করোনা যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব। গৌতম বুদ্ধের জন্মজয়ন্তীকে সামনে রেখে গৌতম বুদ্ধের দর্শনকে আগলে ধরাই বড় দাওয়াই বলে মনে করেন বিশিষ্ট দার্শনিক ডঃ রঘুনাথ ঘোষ। ভারতীয় দার্শনিক অনুসন্ধান পরিষদের স্কলারশিপে গৌতম বুদ্ধের ওপর গবেষণাধর্মী কাজ করে চলেছেন রঘুনাথবাবু। তিনি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্র বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকও। ৭ মে বৃহস্পতিবার ২০২০, গৌতম বুদ্ধের জন্মজয়ন্তী। এবারে করোনা লকডাউনের প্রেক্ষিতে গৌতম বুদ্ধের জন্মজয়ন্তীতে তাঁর কিছু দর্শন খবরের ঘন্টার সামনে মেলে ধরলেন ডঃ রঘুনাথ ঘোষ। চলুন পড়ে নেওয়া যাক, ডঃ ঘোষ ঠিক কি বললেন —

” আজকের দিনে অনেকটাই প্রাসঙ্গিক গৌতম বুদ্ধ। বৌদ্ধ দর্শনতো বিশ্বাস করে, জীবন দুঃখ দিয়ে শুরু। মানে জীবন দুঃখময়। কিন্তু এই দুঃখ যে দূর করা যায় না তা কিন্তু নয়। দুঃখ আছে, তার কারণও আছে। চার রকমের আর্য সত্য মানে প্রধান সত্য বলে চিহ্নিত করেছেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। দুঃখ আছে দুঃখের কারণ দূর করার উপায়ও আছে। জরা, ব্যাধি, মৃত্যু এসব নিয়ে গৌতম বুদ্ধ তার দর্শন আবিষ্কার দিয়ে গিয়েছেন। মানুষের যত লোভ বা তৃষ্ণা বেশি থাকবে ততোই লোভ বেড়ে যাবে। আজকে এটা চাই, কাল আরো চাই, আরো চাই– এই চাই চাই করতে করতে বাসনার লেলিহান শিখা জ্বলতে থাকে আগুনের মতো। এই অতিরিক্ত চাই চাইটাই হল মানুষের কামনাবাসনার আগুন। এই কামনাবাসনার আগুন যতক্ষণ না নেভানো হচ্ছে ততক্ষন কিন্তু ব্যক্তিগত শান্তি নেই, সমাজেও শান্তি নেই। আর এটা নেভানোর জন্য দরকার হলো বাসনার মূলে কুঠারাঘাত করা। হয়তো আমার অত দরকার নেই, তবুও চেয়ে যাচ্ছি, যাকে বলে কামনার বিষয়তৃষ্ণা। এই বিষয়তৃষ্ণা কমাতে গেলে জ্ঞান বা নলেজ দিয়ে কমাতে হবে। সমগ্র জগৎকে অনিত্য ভাবতে হবে। আজ আছি, কাল নেই –স্থায়ী বলে কোন বিষয় নেই। সব ক্ষণিক, স্থায়ী ভাবলেই তৃষ্ণা বেড়ে যাবে। বৌদ্ধ দর্শন বলে জগত হলো অস্থায়ী। বৌদ্ধ দর্শন আরো বলে, জগৎটা শূন্য নয় আবার শূন্য আছে। অর্থাৎ একটি আপেক্ষিক বিষয়। আইনস্টাইনের রিলেটিভিটির সত্যের মতো। প্রত্যেক জিনিসই রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার উপর চলছে। আপনি সাংবাদিকতা করছেন তার ভাল দিক আছে। সমাজের চিত্র তুলে ধরতে পারছেন। আবার অনেকে বলছেন, ন, এটা ঠিক নয়। আসলে স্বাধীনতা বলে কিছু কিছু নেই। সব জিনিসেই এই আপেক্ষিকতা কাজ করে। আপনাকে যদি বলা হয়, আপনি চরম সুখি? হয়তো কিছুদিন বলবেন, সুখী। তারপর একটা সময় সবাই বলবেন, না, আরেকটু হলে ভালো হতো।এটাই অসন্তুষ্টি। আর এই অসন্তুষ্টি থেকে পৃথিবীর সবকিছু দুঃখময়। হিন্দু শাস্ত্রের তপস্যার অন্যতম জায়গা শ্মশান। শাক্তদের অন্যতম সাধনার জায়গা শ্মশান। পাহাড় পর্বতের মত জায়গা থাকতেও শ্মশান কেন সাধনার জায়গা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রণবানন্দজী মহারাজও এই শ্মশানের কথা বলে গিয়েছেন। আসলে শ্মশানে গেলে আমাদের ঔদার্য চলে আসে, অহংকারশূন্যতা চলে আসে। শিলিগুড়িতে যখন মহানন্দা সেতু পার করে যাই শ্মশানঘাটের দিকে তাকিয়ে কোন মৃতদেহ পুড়তে দেখলে মনে হয়, এইতো জীবনের পরিনিতি। আসলে এই যে মৃত্যুর সত্যতা, তা আমরা উপলব্ধি করলে আমাদের কামনাবাসনার স্তর নেমে আসে। বাসনা স্তর একবারে নেমে যাবে তা নয়। কিন্তু অতিরিক্ত বাসনার স্তর নেমে গেলে তাকে বলে মুক্তি বা নির্বান। আগুন জ্বললে তা বালি জল দিয়ে নেভানো হয়। ঠিক একইভাবে মানুষের কামনা-বাসনার আগুন জ্ঞান উপদেশ বা তত্ব দিয়ে অনেকটাই নেভানো যায়। একজন শয়তান ছেলেকে কিছুতেই তার শয়তানি থেকে সরানো না গেলে কাউন্সেলররা একের পর এক তাকে মগজ ধোলাই করতে থাকেন যাতে তার মাথার মধ্য থেকে কুচিন্তাগুলো দূর করা যায়। বৌদ্ধ দর্শন এই কুচিন্তা দূর করার কথা বলে। বৌদ্ধদর্শনে আলাদা বলে ভগবান নেই। হিন্দু বা বৈষ্ণব দর্শনে ভগবান আছে। বৌদ্ধরা ভগবান বিশ্বাস করেনা। তারা মনে করে জ্ঞানই হচ্ছে বিশ্বাসের একমাত্র শক্তি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিংসা উন্মুক্ত পৃথিবীতে কিছু দর্শন দিয়ে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের গানে আছে, শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপূর্ণ– করুণাঘন ধরণীতল করো কলঙ্কশূন্য। বৌদ্ধ দর্শনে আসলে মরালিটি বা নৈতিকতার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। আমাদের বর্তমান যুগেও নৈতিকতা কমছে। মানুষ মন্দিরে যাচ্ছে, পুজো পাঠ করছে কিন্তু নৈতিকতা কতটা বেড়েছে? কতটা সৎ হয়েছি আমরা? যদিও এই করোনা দুর্যোগের সময় বহু মানুষ সৎ ভাবে কাজ করছেন। একজন আরেকজনকে রক্ত দিচ্ছেন, ঠিক আছে। কিন্তু অপরদিকে সততা কতটা বেড়েছে? নৈতিকতার উপর বুদ্ধদেবের চার রকম সূত্র রয়েছে। মৈত্রী, করুণা, মুদিতা এবং উপেক্ষা।মৈত্রী হল সব মানুষকে মিত্রভাবাপন্ন মনে করা। কেউ আমার শত্রু নয়। দলাই লামা বলেছেন, কেউ শত্রুতা করছে বলেই আমি সাবধান হচ্ছি। তাহলে শত্রুতাও একরকম বন্ধুত্ব। শত্রুতা না থাকলে সাবধান হতে পারা যায় না। এর পর আসুন করুণা প্রসঙ্গে। করুনা মানে ভালোবাসো। সবাইকে ভালোবাসো। মুদিতা মানে কেউ কষ্ট পেলেও তা ভুলে গিয়ে আনন্দকে তুলে ধরাই বড় কথা। এরপর আসুন উপেক্ষা। কখনোকখনও কোন জিনিস উপেক্ষা করতে হয়। দুজন লোক মারামারি করছে, সেখানে আপনার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। গেলে হয়তো সমস্যা আরো বাড়বে, তখন অপেক্ষা করতে হবে।
আজ এই করোনা দুর্যোগে এমন অবস্থা যে যিনি করোনা আক্রান্ত তাকে তার আত্মীয়রা ছুঁতে পারছে না, এতটা স্পর্শকাতরতা। অথচ তার অনাত্মীয় যেমন ডাক্তার, নার্স তারা চিকিৎসা করছে। চীন দেশে ৯০ শতাংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আর সেখান থেকেই করোনার উৎপত্তি। ভাবুন মানুষের মৈত্রী, করুণা কতটা কমে গিয়েছে। চীন থেকে করোনার উৎপত্তির বিষয়টি চিন্তা করুন। অনেকে বলছেন, ধ্বংস করার জন্য করোনা ভাইরাস ছাড়া হয়েছে। আমি জাপানের কথা জানি। পরমাণু বোমা নিক্ষেপের পর সেখানে হিরোশিমা-নাগাসাকি চৌচির হয়ে গিয়েছিল। সেখানে প্রায় সকলেই তখন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ছিলেন। সেই সময় জাপানের মানুষদের অনেকেই হিংসা করছিলেন। শুধু হিংসা আর হিংসার জবাবে কিন্তু হিংসা দিয়ে সব জয় করতে চাননি জাপানের মানুষরা। হিংসার বদলে তারা অহিংসা দিয়ে সব জয় করতে কাজে নামলেন। আরি অহিংসাই হল বৌদ্ধ ধর্মের মূল কথা
আজ যদি হিংসা থেকে করোনা ভাইরাস ছাড়া হয় তবে সেই হিংসা তো কোন বৌদ্ধ দর্শনের কথা নয়। বৌদ্ধধর্মে অহিংসা, নৈতিকতার কথাই বারবার বলা আছে।
আমি তো বলব আজ এই যে করোনার মাধ্যমে ধ্বংসের হুমকি। এর পিছনে নীতিবোধের অভাব কাজ করছে। মানুষে মানুষে আজ দলাদলি হিংসা। একটি ট্রেন দুর্ঘটনা হলে দুদল লোক সেখানে যায়। একদল লোক ঘটনাস্থল থেকে যাত্রীদের সামগ্রী চুরি ছিনতাইয়ে ব্যস্ত থাকে। আরেকদল লোক আহত যাত্রীদের বাঁচানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। আজ আমেরিকা করোনা দূর্যোগের সময় হুমকি দিচ্ছে বারবার। এতে তাদের হিংসা বা অহংকার প্রতিফলিত হচ্ছে। বুদ্ধ জন্মজয়ন্তীর এই সময় বলব, পৃথিবীর সব দেশ থেকে হিংসা যদি কমানো যায় তবেই করোনার মতো এইরকম দুর্যোগের সঙ্গে আমরা শক্তির সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারব। কিন্তু তা যদি না হয়, আজ করোনা ভাইরাস এসেছে, কাল আরেক ভাইরাস আসবে। চ্যারিটি বিগিনস এট হোম। নিজের বাড়ি থেকে বদান্যতা শুরু করতে হয়। একটি হিংসার জেরে পাল্টা হিংসা সুখকর নয়। বৌদ্ধ দর্শনের অহিংসার বাণী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারাটাই সবচেয়ে বড় কথা। আর যদি সব দেশে ধর্ম নিয়ে মারামারি হানাহানি বন্ধ হয় তবে পৃথিবীতেও বিরাট পরিবর্তন আসবে। যেখানে মারামারি হানাহানি হয় সে আবার কিসের ধর্ম? সে ধর্ম মেনে কি লাভ? বৌদ্ধ ধর্মের নৈতিকতার দর্শন কিন্তু আমাদের চন্ডীতও আছে। চন্ডীতে বলা আছে, দেবতা এবং নৈতিকতা আলাদা কিছু নয়। দেবী ক্ষমারূপেন সংস্থিতা। এরকম এরকম অনেক তালিকা আছে। ক্ষমারুপেনো, ক্লান্তি রুপেনো, লজ্জা রুপেনো। লজ্জারুপেন মানে আপনাকে কেউ উপকার করল, আপনি তার উপকার নিলেন তারপর তার উপকারের কথা স্বীকার করলেন না। এটা লজ্জারুপেনো। এরকম অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। মূল কথা নৈতিকতা বৃদ্ধি এবং অহিংসা বৌদ্ধ দর্শনের অন্যতম প্রধান তত্ব। আজকের দিনে এই তত্ব গ্রহণ খুবই প্রাসঙ্গিক। আমরা যত তা গ্রহণ করব ততোই ভালো থাকবো।”