ঠাকুরের কথামৃত পড়েই অবসাদ কাটালেন সোনালীদেবী

শিল্পী পালিত ঃ আজকের আত্মকথা বিভাগে চুঁচুড়ার সোনালী মল্লিক লিখেছেন তাঁর কথা। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথামৃত পড়ে তিনি কিভাবে অবসাদ কাটালেন, পড়ুন —

আর পাঁচজনের মতো আমারও ছোটবেলা কেটেছে খুব সাবলীলভাবে। স্কুল থেকে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর কলেজের আঙিনায় পা রাখলাম। চন্দননগর গভর্মেন্ট কলেজ থেকে ফিলোজফি অনার্স । স্কুলের ধরাবাঁধা গণ্ডি ভেঙে নব আনন্দের উচ্ছ্বাস। ক্লাস করার ফাঁকে ফাঁকে গঙ্গার ধারে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া ফুচকা ,ঝাল মুড়ি খাওয়া। বৃষ্টির দিনে কমনরুমে আড্ডা কিংবা তিন তলার ব্যালকনি থেকে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকা ——— ।

তিনটে বছর কোথা দিয়ে কেটে গেল বুঝতে পারলাম না।এবার পা দিলাম বৃহত্তর আঙিনায় বর্ধমান ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। রোজ 8:36 এর বর্ধমান লোকাল। মানকুন্ডু থেকে উঠতাম আমি জনা আর কবিতা। রিষড়া থেকে আসতো তিলোত্তমা আর সুতপা। ওরা উঠে আমাদের জন্য জায়গা রাখত। চন্দননগর থেকে উঠত গীতালি। আদি সপ্তগ্রাম থেকে উঠত শমিতা। এভাবে আস্তে আস্তে আমরা পৌছে যেতাম বর্ধমান। প্রায় দু ঘন্টার ট্রেন জার্নি। হকারের চিৎকার ,ব্যান্ডেলের গরম চায় , এখনো কানে বাজে। ট্রেন থেকে নেমে ইউনিভার্সিটির ফ্রি বাস ধরার জন্য দৌড়। বর্ধমান স্টেশনের টিকিট কালেক্টর সরে দাঁড়িয়ে রাস্তা ছেড়ে দিতেন আমাদের যাবার জন্য কারণ ট্রেনের অর্ধেক যাত্রী স্টুডেন্ট আর আমাদের কারোর কাছেই টিকিট থাকতো না। এই ইউনিভার্সিটির যাওয়া আসায় যে কি আনন্দ তা বলে বোঝানো যাবে না।

আনন্দের মুহূর্ত একদিন শেষ হয়ে গেল পাশ করার পর অবশ্য এক বছর চন্দননগর থেকে বিএড করলাম। নিরানন্দময়। পড়া আর হোমওয়ার্কের চাপেই কেটে গেলো এক বছর।

শুরু হলো জীবনের নতুন অধ্যায়। বিয়ের পর প্রবেশ করলাম নতুন জীবনে। শুরু হলো আমার গৃহবন্দি জীবন। যে জীবনে এক চিলতে বারান্দার বড় অভাব ছিল। বৃহত্তর পৃথিবী ছোট হতে হতে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে গেলাম। একাকীত্ব আর অবসাদ হলো আমার নিত্য সঙ্গী। বাড়ির ছাদে উঠে জেলখানার ( হুগলি ডিস্ট্রিক্ট জেল) পাঁচিলটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। খুঁজতাম আমার আমিকে । আজ কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই তবুও সেদিন কোনো সাহায্যের হাত আমি পাইনি।

এত অবসাদের মধ্যে আশার আলো জ্বালিয়ে কিছু দিন আনন্দের স্বাদ পেয়েছিলাম সন্তান জন্মের পর। কিছুদিন ব্যস্ত ছিলাম তাকে নিয়ে। আস্তে আস্তে আমার হাত ছেড়ে সে তৈরি করল তার নিজের জগৎ। আমি আবার একা। নিত্য রোগ আর নিদ্রাহীনতা হলো আমার নিত্য সঙ্গী। দীর্ঘদিনের নিদ্রাহীনতায় আমি মৃতপ্রায়।একসময় যে সুখ-শান্তির আশায় সংসারকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে ছিলাম ডুবতে থাকলাম সেই সংসারে দঁকে। প্রতি রাতের প্রতিটা ঘণ্টাধ্বনি ছিল আমার সহচর। ফলস্বরূপ ক্লান্তি হলো আমার সারাদিনের সঙ্গী। দীর্ঘ দিন, মাস ,বছর এদের সঙ্গ পেয়ে হারালাম কর্মক্ষমতা, হারিয়ে ফেললাম জীবনে বেঁচে থাকার আনন্দ। কি পাইনি তার হিসাবেই কেটে যেত রাত্র দিন।
দুঃখের তিমিরে ডুবতে থাকলাম।চোখ মেলে তাকাবার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছিলাম। সংসার আমার কাছে হয়ে উঠেছিল দুঃসহ। দিন কাটে তো রাত আর কাটে না। প্রতিমুহূর্তে উপলব্ধি করতাম জীবন যন্ত্রণা। হয়তোবা প্রারব্ধের ক্ষয় । যাকে বলে দিনগত পাপক্ষয়। ঘুরতে থাকে বছর একটু একটু করে কমতে থাকে জীবন দীপ। নঞথক চিন্তায় আবর্তিত হতে থাকি। জীবনের ছন্দটা আস্তে আস্তে কাটতে থাকে। গতানুগতিক জীবনে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। উপলব্ধি হয় সুখ ঐশ্বর্য কখনো শান্তির বিকল্প হতে পারে না। হাঁপিয়ে উঠতে থাকি।

মুক্তি চাই মুক্তি।মনে পড়ে গেল সেই কথাটা ২২ বছর এক চাকাতেই বাঁধা রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরেই রাঁধা। মৃত্যুর পথে যেতে যেতে শেষবারের মতো ভীষণ ভাবে বাঁচতে চেয়েছিলাম। অন্ধকারের মধ্যে পরম করুণাময় ঈশ্বর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। ব্যাকুল হয়ে চাইলে আজও পাওয়া যায়। বাগবাজারে শ্রী শ্রী মায়ের বাড়িতে বেলুড় মঠের মহারাজের কাছে মন্ত্রদীক্ষা পেলাম। ঠাকুর মা স্বামীজীর আশ্রয় পেলাম । রামকৃষ্ণ পরিবারের সদস্য হলাম। ধর্মকে ধারণ করতে শুরু করলাম।

একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়ালাম। কেটে যেতে থাকলেও অবসাদের কালো মেঘ। ফিরে পেলাম আত্মবিশ্বাস। জগতে কাউকে পাল্টানো দুঃসাধ্য তাই বদলে ফেললাম নিজেকে। আস্তে আস্তে ডুব দিতে থাকলাম আধ্যাত্মিকতায়। বুঝতে পারলাম জীবন আমার একার। জগতে কেউ কারো নয়। জীবন প্রদীপ হাতে নিয়ে যে যার মতো এগিয়ে চলেছি।স্বর্গ নয় সংসার থেকেই খুঁজে নিতে হবে টুকরো টুকরো আনন্দ। হাতে পাই অমূল্য গ্রন্থ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-কথামৃত। সত্যই অমৃতের আস্বাদ। আমার বেঁচে থাকার রসদ।

ওম অসতো মা সদ্গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যুর্মামৃতং গময়। ওঁ – – –

সোনালী মল্লিক
চুঁচুড়া হসপিটাল রোড
চুঁচুড়া
হুগলি ৭১২১০১