আমার মেয়ে কানে শুনতে না পারলেও আমার গানের ভিডিও করে দেয়

শিল্পী পালিত ঃ লড়াই, প্রচন্ড লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই কার্যত সঙ্গীত চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন শিলিগুড়ি রবীন্দ্রনগরের শিল্পী সোমা ভট্টাচার্য। পড়ুন আজকের আত্মকথায় তাঁর নিজের কলমে —

আজ অনেক দিন পরে কিছু লিখব ভেবে বসেছি। জানি না ঠিক মতো শুরু আর ঠিক মতো শেষ করতে পারব কিনা! আমি খুব সাধারণ ঘরের একজন মেয়ে। তারপর সাধারণ ঘরের বৌ। আর সবার মতো ছোট্ট আমার সংসার স্বামী ও কন্যা নিয়ে, সুখী সংসার সে অর্থে। খুব ছোটবেলায় যখন কলেজ শেষ করেছি তখন আমার বিয়ে হয়ে যায়। আমার ছোট্ট গ্রাম ‘খরদা’ দার্জিলিং জেলা থেকে অনেক দুরে! মা- বাবা আর একমাত্র মেয়ে আদরের। তবু অনেকটা দুরে চলে এসেছিলাম। বিয়ের একবছরের মধ্যে আমাদের সন্তান লাভ। ছোট্ট ফুটফুটে কন্যা সন্তান। আমাদের স্বামী- স্ত্রীর দুচোখ ভরে স্বপ্ন সন্তানকে ঘিরে।

অনেকদিন আগে বাবাকে বলেছিলাম ‘বাপি আমাকে একটা তানপুরা কিনে দেবে?’ বাবা বলেছিলেন ‘দেব, তুই আগে গ্র্যাজুয়েট/ স্নাতক হ তখন উপহার দেব’। কিন্তু স্নাতক হয়ে তো বিয়ে হয়ে গেল! আর বিয়ের পরে যা হয় সব মেয়েদের আনন্দ, মজা, স্বপ্ন দেখা এই করতে করতে একবছরের মধ্যে কন্যা। তবে তার সঙ্গে আমার গানটা ছিল। তারজন্য আমার স্বামী, আমার শশুর বাড়ি আর সবার পূর্ণ সমর্থন ছিলো। তাই বাবাকে বললাম, ‘তুমি আমাকে তানপুরাটা উপহার দাও আমার মেয়ের একবছর বয়েসের জন্ম দিনে, কারণ ওকেও তো গান শেখাব আমি’! কিন্তু হায়! বিধি বাধ সাধল! বলল এতো সহজে তোর নিষ্কৃতি নেই! সন্তান বড়ো করতে হলে, তোকে অনেক বেশি লড়াই করতে হবে!

আমার মেয়ে যখন একবছর তখন ধরা পড়ল ও একজন ‘বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু’ ওর কানে সমস্যা, যার জন্য ও কানে শুনতে পায় না! আমি তখন বাইশ বছরের একজন দিশেহারা মা! কি করব জানি না! আমার মা যেহেতু রাজ্য সাধারণ হাসপাতালের ( স্টেট জেনারেল হসপিটাল) নার্সিং স্টাফ ছিলেন সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার ও চিকিৎসা শুরু করে দিই। ওর বাবা দার্জিলিং থেকে চিঠি পাঠায় “কি গো, মেয়ে কি বলছে? বাবা বলে! আর কি কথা শিখল!” আমি উত্তর দিতে পারি না! তারপর যাহয় লড়াই আর লড়াই!

তানপুরাটা আমার আর হলো না! ভেবেছিলাম, মেয়েকে গান শেখাব! আমার মেয়ে কিন্তু অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে, বাধা অতিক্রম করে! ও আমাকে পুরো সমর্থন করে। কানে না শুনতে পেলে কি হবে! আমি গান করলে, আমার ভিডিও করে দেয়। আবার কোন নতুন গান দেখলে জিজ্ঞেস করে “মা এই গান টা শুনতে কেমন, সুন্দর না!!” কষ্ট হয় খুব! কিন্তু তবুও বলব এতেই আমি খুশি, খুব খুশি! আমার লড়াই মেয়েকে নিয়ে।

আমি গান করি, কোন নাম কেনার জন্য না। ভালবাসি তাই, আনন্দ পাই তাই, ভালো লাগে তাই! গান করতে ভালো লাগে খুব! এইজন্য আমার স্বামী ও শাশুড়ী মা, আমার নিজের মা আর মেয়েকে কৃতজ্ঞতা জানাই। তানপুরা হয়নি তো কি হয়েছে! আমি এতেই খুশি! তবে এই লেখাটা আমি কেমন লিখেছি জানিনা! কারণ অনেকদিন পরে নিজের কোন কথা লিখলাম। এর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাবো আমার বান্ধবী ও বোন শ্রীমতি শিল্পী পালিত কে। ওর অনুপ্রেরণাতে আমার এই লেখা। অনেক ভালবাসা তোমাকে। ধন্যবাদ।

আমি সোমা ভট্টাচার্য।রবীন্দ্র নগর। শিলিগুড়ি।