মানুষসহ সব প্রানী বাঁচার লড়াই করছে, করোনাও তার বাইরে নয়, জানালেন রসায়নবিদ

বাপি ঘোষঃ এই পৃথিবীর সব কীটপতঙ্গ, মানুষ সহ সব প্রানী বাঁচার জন্য লড়াই করছে। করোনাও তার বাইরে নয়। খবরের ঘন্টার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একথা জানালেন উত্তরবঙ্গের মাইক্রোবায়োলজিস্ট তথা রসায়নবিদ দীপক রঞ্জন সেন। শিলিগুড়ি দুই মাইল জ্যোতিনগরে দীপকবাবুর একটি শিল্প কারখানা রয়েছে। নাম পিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। সেই কারখানায় বিভিন্ন গাছের প্রতিষেধক-সার এবং মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধির বিভিন্ন জৈব সার তৈরি হয়। পিক বায়োটেক নামের সেই সব জৈব কৃষির সার বিভিন্ন চা বাগান এবং কৃষকদের কাছে সরবরাহ হয়। আর এরজন্য দীপকবাবুর কারখানার ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন রকম ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের ওপর চর্চা বা গবেষণাও হয়। সেই কারনে নিয়মিত দীপকবাবু তাদের কারখানাকে স্যানিটাইজ করে আসছেন। করোনা এবং বর্তমান অবস্থা নিয়ে দীপকবাবু জানালেন অনেক কথা। প্রসঙগত দীপকবাবু একজন শিল্পপতিও–

” আমরা মাইক্রোবায়োলজি প্রডাক্ট বা মাইক্রোঅর্গানিজম নিয়ে কাজ করি। তাদের কোয়ারেনটাইন, স্যানিটাইজেশন,গ্রোথ নিয়ে কাজ করে আজ পঁচিশ বছর ধরে আমার শিল্প চালিয়ে আসছি। যারা আমাদের সেই শিল্প কারখানায় কাজ করে তাদের নিজেদের সুরক্ষা নিতে বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। এরমধ্যে একটি বড় পদ্ধতি হলো, সমগ্র কাজের এলাকাটি স্যানিটাইজেশন করা যাতে কারও ক্ষতি না হয়। যদিও আমরা যেসব ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক নিয়ে কাজ করি সেগুলো বিশেষ ক্ষতিকারক নয়। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ্য করা গেছে, যেসব নিয়ে আমরা কাজ করি তারমধ্যে কোনও কোনও প্রডাক্ট বা মাইক্রোঅর্গাজম কখনও মিউটেশন হয়ে অন্য একটি এনজাইমেটিক রিয়্যাকশন হয় যা কখনও কখনও মানুষ বা প্রানীজগতের ক্ষতিকারক হতে পারে। আর সেই ক্ষতি যাতে না হয় তারজন্য আমরা টেস্টিং প্লেট তৈরি করি। বিভিন্ন মাইক্রোস্কোপের নীচে সেসব টেস্টিং প্লেট দেখে তাদের চরিত্র চিহ্নিত করি– কোনটা ভালো, কোনটা ক্ষতিকারক। সেসব আবার কি এনজাইম, এন্টিবডি তৈরি করছে তা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। করোনা দুর্যোগ শুরু হওয়ার পরপরই আমরা কিন্তু সতর্ক হয়ে পড়ি। এমনিতেই আমাদের ল্যাবরেটরি, কারখানার কাজের এলাকা নিয়মিত স্যানিটাইজ করি। প্রতি শনিবার আমরা আমাদের কারখানা বিশেষভাবে ফিউমিগেশন, স্যানিটাইজ করি। রবিবার কারখানা বন্ধ থাকে। সোমবার খোলে। কোনও জীবানু যাতে অজান্তে ক্ষতি করতে না পারে তারজন্য ওই ফিউমিগেশন বা স্যানিটাইজেশন করা হয়৷ করোনা দুর্যোগও শুরু হতেই কিন্তু আমরা কারখানা ফিউমিগেশন, স্যানিটাইজেশন করে লকডাউনে সামিল হই৷ সব কর্মচারীকে যার যা প্রাপ্য দেওয়া হবে বলে সকলকে ছুটি দিয়ে লকডাউন করা হয়।
আমি চারবার চীন গিয়েছি। চীনের বিভিন্ন শিল্প কারখানা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখেছি। ওদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি কিন্তু অনেক উন্নত বলতেই হবে। এই করোনা ভাইরাস ওদের ল্যাবরেটরিতে কোনও ভুলের জেরে বাইরে এসেছে নাকি প্যাঙ্গোলিনের মাংস খাওয়া থেকে এসেছে সেসব অনেক তর্কের বিষয়। তবে এটা পরিস্কার বলা যায়, করোনা এমন একটি ভাইরাস যেটি মিউটেশন হয়ে গিয়েছে। পরিবেশে অনেক ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক আছে। এসবের প্রায় সবই আমাদের শরীরের সঙ্গে মানানসই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই নতুন করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আমাদের কাছে আগে থেকে না থাকাতেই যত বিপত্তি।
মিউটেশন মানে বিরুদ্ধ পরিবেশে নিজেকে মানানসই করে তোলা। আপনি এখন এসি ঘরে আছেন, সেখানে এক পরিবেশ। এসি ছেড়ে বাইরে গেলেন, সেখানে এক পরিবেশ। দুই পরিবেশেই কিন্তু আপনার শরীরকে মানানসই করে নিতে হয়। আপনার ঠান্ডা লাগছে তখন আপনি কম্বল গায়ে দিলেন যাতে আপনি ভালো থাকেন। করোনা ভাইরাসও তাই, সেও পরিবেশে নিজেকে মানানসই করে তুলতে মনে করুন কম্বলের মতো একটি আবরন দিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেলেছে মানে মিউটেশন করে ফেলেছে। এখন আপনাকে কম্বল গায়ে দেওয়া অবস্থায় ধরতে গেলে আপনার গায়ের কম্বল সরাতে হবে তারপর ধরতে হবে। সেইরকমই মিউটেশন দ্রুত করে নেওয়াতে করোনাকে ধরতেও একটু কষ্ট হচ্ছে। মনে করুন আপনি এখন মরুভূমিতে আছেন হঠাৎ আপনাকে এন্টার্কটিকা পাঠিয়ে দেওয়া হলো। দুজায়গায় দুরকম পরিবেশ৷ দুজায়গায় দুরকম পরিবেশে আপনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলে টিকে থাকবেন। যখন যেমন পরিবেশ তার সঙ্গে আপনাকে এডজাস্ট করাতে হবে। শীতকালে গরম জামাকাপড়, গরম কালে হালকা শার্ট। বর্ষায় রেইনকোট বা ছাতা। আমাদের মতোনই পরিবেশে টিকে থাকার জন্য ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসগুলো বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে। করোনা ভাইরাস নিয়ে যেটা চিন্তা তা হলো এই ভাইরাস খুব তাড়াতাড়ি নিজেদের মিউটেশান করে নিচ্ছে। বিরুদ্ধ পরিবেশে এডজাস্ট করে এরা নিজেদের বৃদ্ধি ঘটিয়ে নিচ্ছে। সাধারণত তাপমাত্রা একটু বেশি হলে ভাইরাস টিকতে পারে না পরিবেশে। এপ্রসঙ্গে একটি কথা বলতে হয় কিছু কিছু ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া কিন্তু অত্যন্ত উত্তপ্ত পরিবেশেও টিকে থাকে। যেমন ভলকানোর মধ্যে থেকে গলিত আগুনের লাভা বেরিয়ে আসা পরিবেশেও কিছু ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া টিকে থাকে। এখন এই করোনা ভাইরাস মানুষের কাছে নতুন। যেটুকু জানা গিয়েছে, এই ভাইরাস দ্রুত নিজেদের মিউটেশান করিয়ে নিচ্ছে। এখন মে মাসের চূড়ান্ত গরমেও এরা নিজেদের মানিয়ে নেবে কিনা তা সময়ই বলবে। খুব কঠিন এক পরিস্থিতি। এজন্য বিজ্ঞানীদের আরও বেশি বেশি করে গবেষনা চালিয়ে যেতে হবে। তবে আপাতত যাতে করোনা আমাদের ক্ষতি করতে না পারে তারজন্য লকডাউন, হাত ধোয়া, স্যানিটাইজেশন, ভিড়ে না যাওয়া, মুখে মাস্ক ব্যবহার করা প্রভৃতি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে৷ তবে প্রকৃতির নিয়মে কিন্তু কিছুদিন বাদে এসব ভাইরাস মিলিয়ে যায়। এবং মানুষের শরীরে পরিবেশের নিয়মেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায়।
এখন মানুষকে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে নজর দিতে হবে। তা হলো শরীরে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বা অ্যান্টিবডি তৈরি করা। প্রানী জগতের নিয়মই হলো বিরুদ্ধ পরিবেশে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। যার শরীর যত দুর্বল তার শরীরে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কম থাকায় তার অসুখও বেশি। শরীরে রোগ প্রতিরোধক শক্তি বেশি থাকলে শরীরের ভিতরকার সৈন্যগুলো বাইরের ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকে শরীরে প্রবেশ করতে দেয় না। বা বলা চলে শরীরের ভিতরকার সৈন্যগুলো শক্তিশালী হলে বাইরে থেকে আসা ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াগুলোকে মেরে ফেলে। এখন যদি শরীরের মধ্যেকার সৈন্যগুলো দুর্বল হয় তবে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া জয়ী হয়ে যায়। এপ্রসঙ্গে ডারউইনের থিওরি মনে করা যেতে পারে। স্ট্রাগল ফর এগজিসটেন্স এন্ড সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট। বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। যে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করবে সেই টিকে থাকবে। আর সেই রাজ করবে। প্রতিটি কীটপতঙ্গ প্রানী এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে। আজ করোনা ভাইরাসও কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য নিজের মিউটেশন করিয়ে লড়াই চালাচ্ছে। করোনা বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকার জন্য খুঁজছে মানুষের শরীর। তাই বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে বা হাত স্যানিটাইজ করতে হবে। করোনা একটু সুযোগ পেলেই নাকমুখচোখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে তার সংসার পাতার বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করে। শুধু তাই নয়, করোনা তার বিরাট সংসারের জাল বিস্তার করার জন্য আপনার থেকে আপনার কাছাকাছি সকলের মধ্যে সংসার পাততে চায়। তাই আপনি এই পরিবেশে টিকে থাকবেন না করোনা, ভেবে দেখুন।
এবার বলবো এই করোনা কিন্তু দুর্যোগ নিয়ে এলেও ভারতের কাছে অন্যরকম কিছু বার্তাও এনেছে। চীন এই করোনা সংক্রমনের জন্য দায়ী বলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ অভিযোগ করছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশই এখন চীনের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন মহলে অভিযোগ বা প্রচার করা হচ্ছে, চীন বহু দিন ধরে বিশ্বের এক নম্বর শক্তি হতে চায়। আজ কিন্তু এই করোনার সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিট, মাস্ক, স্যানিটাইজার সরবরাহ করে চীন বাণিজ্যও করছে। যদিও আজ চীনের এত শক্তি হওয়ার পিছনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ দায়ী। কেননা সবাই এতদিন চীনের পন্য সমানে ব্যবহার করে এসেছেন। চীনের পন্য সস্তা বলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ চীনকে দিয়ে বিভিন্ন পন্য তৈরি করিয়েছে বা অর্ডার দিয়েছে। এটা একটা বিরাট ভুল। আমাদের জন্যই আজ চীন এত অর্থনৈতিক ক্ষমতা পেয়েছে। আর এর মাশুল গুনতে হবে সব দেশকেই। একজন বানর যদি আর একজন বানরকে গড়িলা বানিয়ে দেয় তবে সেই গড়িলা কিন্তু তার নির্মাতা আদি বানরটিকে একদিন খেতে আসবে। চীনের ক্ষেত্রেও তেমনটিই ভাবুন।
এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ কিন্তু চীনের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে ভারতের ওপরই আস্থা রাখছে। এশিয়ায় চীনের পরই ভারতের শক্তি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এখন ভারতের ব্যাপক শক্তি বৃদ্ধি চাইছে। কারন ভারতে জনসংখ্যা প্রচুর, শিক্ষাও কম নেই। তাই চীনের বিকল্প হিসাবে ভারতের ব্যাপক উন্নয়ন চাইছে অনেক দেশ। তারা বিভিন্নভাবে ভারতকে সাহায্য করতেও প্রস্তুত। এই অবস্থায় আমি বলবে, ভারতের প্রশাসন সেই ভাবে কাজে নেমে পড়ুক। শুধু করোনা মোকাবিলা নয়, ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞান, বিজ্ঞান প্রযুক্তি, বায়োটেকনোলজি কম উন্নত নয়। এখন থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এইসব বিভিন্ন শাখায় ভারত সরকার যদি আরও বেশি করে অর্থ নিয়োগ করে এবং গবেষণার পিছনে আরও শক্তি দিয়ে কাজে নেমে পড়ে তবে সামনে ভারতের সামনে বিরাট শক্তিধর এক দেশ হওয়ার বিরাট পরিস্থিতি তৈরি হবে। বিজ্ঞানীদের গবেষণাগুলো পেপার ওরিয়েন্টেড না করে ইমপ্লিমেন্টেশন এ বেশি করে নজর দিতে হবে। আর বিজ্ঞানীরা শুধু চাকরি করার জন্য নয়, দেশ ও সমাজের জন্য কিছু করতে হবে এই ভাবনায় আরও বেশি করে ঝাপ দিলে অনেক সুফল আসবে। ভারতের আর একটি সুবিধা আছে। ভারত গণতান্ত্রিক দেশ। সংসদে সব আলোচনা হয়, দেশের নাগরিকদের মত প্রকাশের অধিকার আছে। চীনে কিন্তু তা নেই। সেখানে শুধু প্রেসিডেন্ট রুল। ডিকটেটরশিপ। ভারত যদি চেষ্টা করে তবে এইসময় বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সহায়তায় পৃথিবীর বিরাট শক্তিধর উন্নত দেশে পরিনত হতে পারে। আজ করোনার কিটের জন্য কেন চীনের অপেক্ষায় থাকতে হবে? করোনা দুর্যোগ আনলেও কিন্তু অনেক সম্ভাবনাও তৈরি করেছে ভারতের সামনে। তবে এজন্য ভারতের সরকার, নাগরিক সকলকে লড়াইয়ে নামতে হবে।
আর বাংলার ক্ষেত্রে বলবো, এইসময় লকডাউন হওয়ায় দক্ষিন ভারত বা অন্য রাজ্যগুলো থেকে বহু দক্ষ শ্রমিক বা কর্মী বাংলার বাড়িগুলোতে ফিরেছে। এইসব দক্ষ শ্রমিক কর্মচারী দিয়েই কিন্তু অন্যরা এগিয়ে যাচ্ছে। এখন যদি এই সব দক্ষ শ্রমিক কর্মচারীদের বাংলায় আটকে রেখেই তাদের কাজে লাগিয়ে শিল্প কারখানায় নামিয়ে দেওয়া যায় বাংলাতেই তবে বাংলা দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। ঘরে থাকুন। ”