খেলা শেখানোর থেকে দুঃস্থদের মধ্যে ত্রান বিলি করে বেশি আনন্দ হচ্ছে বঙ্গরত্ন ভারতী ঘোষের

বাপি ঘোষঃ টেবিল টেনিসের জন্য তিনি নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। এই ছিয়াত্তর বছর বয়সে প্রবেশ করেও টেবিল টেনিস শেখানোর কাজ ছাড়েননি। প্রকৃতপক্ষে টেবিল টেনিসের প্রতি বিরাট অবদানের জন্য কিছু দিন আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে বঙ্গরত্ন সম্মান দিয়েছেন। সেই বিশিষ্ট টেবিল টেনিস প্রশিক্ষক ভারতী ঘোষ এই লকডাউনের সময় তাঁর শিলিগুড়ি দেশবন্ধুপাড়ার বাড়ি থেকে নিঃশব্দে ত্রান বিলি করে চলেছেন দুঃস্থদের মধ্যে। রবিবার খবরের ঘন্টার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেন, খেলা শিখিয়ে জীবনে যত না আনন্দ পেয়েছি তার থেকে বেশি আনন্দ পাচ্ছি অভুক্ত মানুষদের মধ্যে ত্রান বা খাদ্য বিলি করে। তিনি আরও কি কি বললেন, তা জানতে নিচের লেখা পড়ুন ওনার মুখ থেকেই—

” যেদিন থেকে লকডাউন শুরু, সেদিন থেকে আমার টেবিল টেনিস শেখানো বন্ধ আছে। কারন করোনার সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হতে গেলে লকডাউন ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ঘরে শুয়ে বসে সময় অযথা নষ্ট করে লাভ নেই। বয়স ৭৬ পেরিয়েছে। ভোর বেলা একটু একা মুখে মাস্ক বেঁধে একটু হাঁটাহাঁটি করি। তারপর ঘরে শরীর চর্চা । এরপর শুরু হয় মানবিক কাজ। শিলিগুড়ি বর্ধমান রোডের রিষি ভবনে প্রতিদিন বহু অভুক্ত মানুষদের জন্য রান্না করা খাবারের প্যাকেট তৈরি হচ্ছে। ওদের আমি প্রস্তাব দিয়েছি, একেকদিন একেকরকম খাবারের প্যাকেট দিতে। সেই অনুযায়ী ওরা কোনওদিন ভাত ডাল সব্জি, কোনওদিন খিচুড়ি সব্জি, কোনওদিন ফ্রায়েড রাইস দিচ্ছে। আজ যেমন ওরা খিচুড়ি সব্জি দিয়েছে। ওদের ওখান থেকে আমার কাছে প্রতিদিন ৫০ প্যাকেট খাবার আসছে। তারপর আমি সেসব বিভিন্ন অভুক্ত মানুষদের মধ্যে বিলি করছি নিঃশব্দে। সবাইকে ফোন করে ডেকে নিচ্ছি। ফোনেই বলে দিচ্ছি, মাস্ক বেঁধে আসতে হবে। আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কেও হুড়োহুড়ি করে আমার ঘরের সামনে আসবেন না। এমনকি আমার দরজা জানালাও কেও স্পর্শ করবেন না। ওরা তা শুনছে। দূর থেকে ওরা ওদের খাবার নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন এই কাজটি করছি। কাওকে সুকনো খাবার দিচ্ছি। এইসব অভুক্তদের সঙ্গে এই দুর্দিনে থাকতে পেরে বেশ আনন্দ হচ্ছে। খাবারের প্যাকেট দূর থেকে নিয়ে ওদের অনেকে দুঃখের মধ্যেই হাসছে। তা দেখে আমিও হাসছি, আমার আত্মা হাসছে। এমন দুর্যোগ জীবনে দেখিনি। অভুক্তদের হাসিতে রাখাইতো বড় কাজ। আমার এই নিঃশব্দ প্রয়াসে যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের নাম উল্লেখ করতেই হয় — সমাজসেবী খোকন ভট্টাচার্য, হরি বিশ্বাস, দুর্গা চক্রবর্তী, সন্ধ্যা পাল, মুন্নি লাহা, দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত। এদের অনেকে টাকাপয়সা দিয়েও সাহায্য করছেন। সব টাকা দিয়ে খাবার কেনাচ্ছি আর বিলি করছি। চল্লিশ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্নকেও দেওয়া হয়েছে খাবার। চাল, ডাল, আলু, তেল। আজই আশিঘর থেকে ফোন এসেছিলো। ওখানে কিছু মানুষ কষ্টে আছেন। ওদের কিছু ত্রান দেবো। নিজের পেনশনের টাকাটাও এইসময় ত্রানের পিছনে কাজে লাগছে। না, কোনও ছবিটবি তুলছি না। অভুক্তরা ত্রান পেয়ে হাসছে, ওটাই আমার আত্মা ও মনের ছবি।
যারা খেলার জন্য যোগাযোগ করছে, বলে দিচ্ছি, এখন কোচিং বন্ধ। তোমরা সবাই বাড়িতে থাকো। অনেক খেলার যুদ্ধে জয়ী হয়েছো, এবার করোনার বিরুদ্ধে জয়ী হও। বাড়িতে শরীর চর্চা করো, শ্যাডো প্র্যাকটিস করো। টেবিল টেনিসে আন্তর্জাতিক পদক জয়ী বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন খেলোয়াড় পলি সাহার মা-ও ফোন করেছিলেন। ওর মাকে বলে দিয়েছি, পলি যেন এইসময় শুয়ে বসে সময় নষ্ট না করে। যেন শরীরচর্চা আর শ্যাডো প্র্যাকটিস করে। শরীর চর্চা রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে। আর ঘর থেকে একদম বের হওয়া যাবে না। তারপর কাওকে অসতর্ক দেখলে দূর থেকে সাবধান করে দিচ্ছি। যেমন আজ সকালে বাড়ির সামনে কয়েকজন উঠতি বয়সের পাঁচ ছয় জন ছেলেকে একসঙ্গে যেতে দেখে বললাম, তোমরা মুখে মাস্ক বেঁধে রাখো নি কেন? আর দূরে দূরে থাকছো না কেন? ওরা দেখলাম শুনলো আমার কথা। বলা মাত্রই দূরে দূরে সরে গেলো। আর জানালো, মাস্ক বাঁধবো। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। এবং ঘরে থাকুন। কষ্ট হলেও করোনাকে হারাতে হবে। আমার ছেলেমেয়েরা অনেক খেলায় জয়ী হয়েছে। এবার এই খেলায় জয়ী হতেই হবে ঘরে থেকে। ”
( বঙ্গরত্ন তথা টেবিল টেনিসের অসামান্য প্রশিক্ষক ভারতী ঘোষ খবরের ঘন্টা পত্রিকার উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্যা।)