বিনা প্রয়োজনে যারা লকডাউন উপেক্ষা করে বাইরে বের হচ্ছেন তাদের অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করার অভিমত পরিবেশবিদের

বাপি ঘোষঃ করোনার জেরে লকডাউন শুরু হয়েছে। কিন্তু কিছু মানুষ বিনা প্রয়োজনে লকডাউন উপেক্ষা করে বাড়ির বাইরে বের হচ্ছেন। এইসব মানুষকে এখন অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার সময় এসেছে বলে অভিমত জানালেন শিলিগুড়ি তথা উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট পরিবেশবিদ দীপজ্যোতি চক্রবর্তী। অপটোপিক নামে একটি পরিবেশ সংগঠনের কর্নধার দীপজ্যোতিবাবু। তিনি দীর্ঘদিন ধরে শিলিগুড়িতে নদী বাঁচাও, পরিযায়ী পাখি বাঁচাওয়ের আন্দোলন করে আসছেন। বর্তমান করোনা দুর্যোগ নিয়ে তিনি খবরের ঘন্টার কাছে অনেক কথাই জানালেন। পড়ুন সেসব নিচের অংশে–

“এই করোনা মারন ভাইরাস কিন্তু আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। করোনা ঠেকাতে লকডাউন ছাড়াও আমাদের আরও অনেক সরকারি নির্দেশিকা মেনে চলা জরুরি। করোনা এমন একটি রোগ যে সে আপনার কাছে আসবে না। আপনি যদি তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসেন তবেই সে আপনার কাছে আসবে। তাই ঘরে থাকাই এর বিশেষ ওষুধ।
করোনা আমাদের আরও অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। যেমন ধরুন পরিবেশের কথা। পরিবেশ দূষন এখন কমে গিয়েছে। কলকারখানা, নদীনর্দমার মাধ্যমে আমরা পরিবেশ বিষিয়ে তুলছিলাম। নদীগুলোতে একনাগাড়ে আমরা বর্জ্য ফেলছিলাম। এখন কিন্তু পৃথিবী জুড়েই সেসব নদী পরিস্কার হচ্ছে। একটি জায়গায় পড়ছিলাম, গঙ্গার জলও এখন দারুণভাবে দূষণমুক্ত হচ্ছে। গঙ্গার জল আমরা পবিত্র হিসাবে ধরি। সেই জল এখন এই লকডাউনে আরও পবিত্র হচ্ছে। মুম্বাইতে মেরিন ড্রাইভ এর সামনে ডলফিন দেখা যাচ্ছে।
আমরা আধুনিক থেকে আধুনিক হতে গিয়ে সমানে সবুজ ধ্বংস করছিলাম। নদী বুজিয়ে ফেলছিলাম। কলকারখানার দূষন করছিলাম। বিগত এক মাসে কিন্তু অনেক পরিবর্তন এসেছে পরিবেশে। আমি আমার বাড়ির বেড রুমে ব্যালকনি থেকে অনেকরকম পাখির ডাক শুনছি। শিলিগুড়ি হিলকার্ট রোডে এতদিন ধরে গাড়ির ধোঁয়ায় বীভৎস অবস্থা তৈরি হয়েছিল। বায়ূ দূষন চরম মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিল। এখন কিন্তু সামনে সুকনার জঙ্গল থেকে অনেক পাখি আসছে শহরে। শহর থেকে পাহাড়ের অনেক কিছু এখন দৃশ্যমান। আসলে আমরা প্রকৃতি ধ্বংস করে বাস্তুতন্ত্রকে নষ্ট করছিলাম। নদী কোনও শাসন মানে না। কিন্তু আমরা নদীকে একনাগাড়ে শাসন করছিলাম। নদী থেকে অনেক মাছ, ব্যাং, পোকামাকড় হারিয়ে যাচ্ছলো। আজ কিন্তু শহরে বাঘ ফড়িংও বেশ উড়তে দেখা যাচ্ছে।
করোনা হয়তো চলে যাবে। আমাদের সভ্যতাও করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করে আশা করি জয়ী হবে। কিন্তু যে শিক্ষা করোনা আমাদের দিয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না। শিক্ষা হলো, প্রকৃতি পরিবেশকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। করোনা অভিশাপ হয়েও কিছু আর্শীবাদ আমাদের দিয়ে যাচ্ছে।
এবারে বলি কিছু লোকের লকডাউন না মেনে চলা প্রসঙ্গে। কিছু চাকুরীজীবি মানুষ আছেন যারা মাস গেলে বেতন পান। লকডাউনের জেরে ব্যবসায়ীরা সঙ্কটে পড়লেও চাকরিজীবিরা বেতন ঠিকঠাক পাচ্ছেন। এই চাকরিজীবিরা আগে সপ্তাহে পাঁচ দিন অফিসে যেতেন। শনিবার বা রবিবার তারা বাজারে যেতেন। এখন অফিস নেই। ফলে কাজতো কিছু করতে হবে, পয়সাতো কিছু খরচ করতে হবে। তাই তাদের কেও কেও এই লকডাউনের সময় বাজারে যাচ্ছেন রোজ। এটা সেটা মাছ মাংস তারা কিনে আনছেন। অন্তত বাজারের কিছু বিক্রেতার কাছ থেকেই এমন তথ্য আমি জানতে পারছি। এই সব লোকদের কিছু বাইরে যাওয়ার প্রবনতা ছাড়া আবার কিছু লোক অকারনে বাড়ির বাইরে বের হচ্ছেন। কেও আড্ডা দিতে চাইছে, কেও পাড়ার মোড়ে জটলা করতে চাইছে। কেও আবার খেলার চেষ্টা করছে। কেও মদ্যপান করার জন্য বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন। কেও জুয়া খেলতে বের হচ্ছেন। সাংবাদিকরা সেসব ছবি তুললে এই শিলিগুড়ি শহরেই তাদের ওপর হামলা হচ্ছে। এ আমাদের চরম লজ্জা। সাংবাদিক, ডাক্তার, নার্স আমাদের সমাজের জন্যই এই দুর্যোগে কাজ করছেন। অথচ তাদের ওপর কোথাও কোথাও হামলা হচ্ছে। আমার মতে এই অকারণে বাইরে বের হওয়ার প্রবনতা আগামীতে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করতে পারে। বিদেশে লকডাউনকে তাচ্ছিল্য করার ফল ওরা ভুগতে শুরু করেছে। ওদের ওখানে করোনা হু হু করে বাড়ছে। আমরা এখন সতর্ক না হলে আমাদের এখানেও মৃত্যু মিছিল শুরু হবে। শবদেহ দাহ করার লোক পাওয়া যাবে না। পুলিশ প্রশাসন যথেষ্ট কাজ করছে। এখন আমাদের নিজেদের সচেতন হতে হবে। যারা অকারনে বাইরে বের হচ্ছেন তাদেরকে রাজবিদ্রোহের পর্যায়ে ফেলার প্রস্তাব দিচ্ছি আমি। এরা শুধু নিজেদের জীবন নয়, অন্যের জীবনও বিপন্ন করে তুলছে। এদেরকে অপরাধী হিসাবেও গণ্য করা যায়। আর বাজারঘাট? আজকালতো বাড়ির গলিতে প্রচুর সব্জি ও মাছ বিক্রেতা আসে। আগে দুজন সব্জি বিক্রেতা হাঁক পাড়লেও এখন দশজন হাঁক পাড়ছে। সেখান থেকে অনায়াসে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সব্জি মাছ কেনাা যায়। বাজারে শুধু শুধু ভিড় না করলেও চলে। শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনের সামনে পুলিশ বাঁশ দিয়ে বাজার ব্যারিকেড করে দিয়েছে। বেশ করেছে। পুলিশ এরকম কড়া মনোভাব চালিয়ে যাক। কিছু অসভ্য, কথা না শোনা লোকজনকে এভাবেই শায়েস্তা করা দরকার।
ত্রান নিয়েও দুএকটি কথা বলবো। যারা ত্রান দিচ্ছেন তাদের স্যালুট। খুব ভালো কাজ করছেন। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ত্রান বিলির নামে হুড়োহুড়ি। ছবি তোলার প্রতিযোগিতা চলছে। কোনও মাস্ক নেই মুখে, কোনও সামাজিক দূরত্ব নেই। এর ফলে যিনি ত্রান দিচ্ছেন এবং যিনি দিচ্ছেন উভয়ের সামনে বিপদ আসছে নাতো? আমার মনে হয়, এবার এই বিষয়টি নিয়েও একটি লাগাম টানা দরকার। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে একদম কড়াকড়ি মানে করোনা সতর্কতা পুরোপুরি মেনে ত্রান বিলি করলে আমার আপত্তি নেই।
এবার বলবো পর্যটন নিয়ে। করোনা যতগুলো ক্ষতি করেছে তারমধ্যে অন্যতম হলো পর্যটন শিল্পের। পর্যটনের বহু মানুষ কাজ খুইয়ে বসে পড়েছেন। হোটেল শিল্পও মুখ থুবড়ে পড়েছে। অথচ সরকারের বিরাট রাজসু আসে পর্যটন থেকে। তাই সরকারের কাছে আমার প্রস্তাব, পর্যটন ও হোটেল শিল্পের জন্য কিছু প্যাকেজ, কিছু সুবিধা আসুক। এতদিন এই এলাকার পর্যটনকে যারা এগিয়ে দিতে আপ্রাণ লড়াই করেছেন এখন তাদের পাশে সরকারকে দাঁড়াতে হবে যাতে আগামী দিনে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে পর্যটন শিল্প। এখন যা অবস্থা এই করোনার দুর্যোগ এবার পুজো পার করে এই বছরটাই শেষ করে দিতে পারে। সিকিম, রাজস্থানের মতো রাজ্যতো কার্যত পর্যটনের ওপর দাঁড়িয়ে।
সবশেষে বলবো, পরিবেশ না বাঁচলে কিন্তু সামনে আমাদের জন্য অন্ধকার পৃথিবী অপেক্ষা করছে। তাই পরিবেশ প্রেম আমাদের সকলকে আরও বেশি বেশি করে বাড়িয়ে তুলতে হবে। ”
( দীপজ্যোতি চক্রবর্তী বিশিষ্ট পরিবেশবিদ এবং তিনি খবরের ঘন্টা পত্রিকার উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য)