বাপি ঘোষঃ করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় যতক্ষন প্রতিষেধক ওষুধ না আসে ততক্ষন রোগ প্রতিরোধক শক্তি বৃদ্ধির কথা বলছেন অনেকে। আর এই অবস্থায় উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রানী বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ সৌমেন ভট্টাচার্য জানালেন, হতাশা বা মানসিক অবসাদ কিন্তু রোগ প্রতিরোধক শক্তি কমিয়ে দেয়। করোনার বিরুদ্ধে শুরু হওয়া যুদ্ধে জয়ী হতে তিনি ফুসফুসের কিছু ব্যায়াম যেমন প্রানায়াম করার ওপরও জোর দিয়েছেন। জেনেটিক্স মলিকিউলার বায়োলজির ওপর বিশেষ গবেষণাপত্রও রয়েছে এই অধ্যাপকের। তিনি করোনার ওপর খবরের ঘন্টাকে আরও অনেক কথাই জানিয়েছেন। আসুন তিনি কি বলছেন, পড়ে নেওয়া যাক —
” বিভিন্ন খবরে প্রকাশিত ধারণা থেকে আমি যেটা বুঝেছি, এটি চিন দেশের এক ল্যাব থেকে ছড়িয়েছে । যেটা দুর্ঘটনাবশত বাজারে চলে এসেছে। বা একটিদুটি মানুষের মাধ্যমে অন্য লোকের মধ্যে ছড়িয়েছে। ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশের পর দশ থেকে চৌদ্দ দিন সময় লাগে লক্ষন প্রকাশ পেতে।এখন ওই চৌদ্দ দিনের মধ্যে চিনের উহানের মতো বাণিজ্যিক জায়গায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন এসেছেন। উহানের কাছাকাছি যেসব গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে যেমন সাংহাই বা তার কাছাকাছি এক দেড় ঘন্টার রাস্তা, যেখানে অনেক ভারতীয় ছেলেমেয়ে ডাক্তারি পড়তে যায়, তারাও আগে জানতে বা বুঝতেই পারেনি যখন করোনা ভাইরাস উহান থেকে ছড়াতে শুরু করেছে।
এই ভাইরাসটির মধ্যে দুধরনের সিগনেচার রয়েছে। একটি হলো বাদুড়ের শরীরের ভাইরাস যে ভাইরাস সাধারণভাবে মানুষকে সংক্রমণ করতে পারে না। আর একটি হলো পেঙ্গোলিন। পিপীলিকাভুক একপ্রকার পেঙ্গোলিন রয়েছে যাদের শরীরেও করোনা ভাইরাস থাকে। এই করোনা ভাইরাস বা কোভিড সার্সে কিছুটা বাদুড় কিছুটা পেঙ্গোলিনের অংশ পাওয়া গিয়েছে। যদিও মারক হিসাবে এই ভাইরাস মারাত্মকভাবে কার্যকরী নয়। ফলে তিন থেকে চার শতাংশ লোক মারা যাচ্ছে। সবাই এতে মারা যাচ্ছে না। এইরকম একটি ভাইরাস যদি কোনও মানুষ দুষ্টুমি করে বানিয়েও থাকে তাহলে এই মুহুর্তে সে তা ছাড়লো কেন? কেননা সে ভাইরাসতো পুরোপুরি মানুষ মারতে পারছে না!
১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুতে দেখা গিয়েছিলো তার মারন ক্ষমতা অনেক বেশি ছিলো। পাঁচ কোটি মানুষ সেবারে মারা গিয়েছিলো। তাহলে এবারে করোনার মতো একটা ইমম্যাচিওর ভাইরাস বাজারে চলে এলে কিকরে? চলে এলো খুব সম্ভবত দুর্ঘটনাবশত। বড় বড় বিজ্ঞানীরাও তাই বলছেন। আমারও তেমনই ধারণা।
করোনা ভাইরাসের মধ্যে শূড়ের মতো স্পাইক বেরিয়ে থাকে। এটি একটি প্রোটিন। এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে তার স্পাইক প্রোটিন আমাদের ফুসফুসের কোষের সঙ্গে বেঁধে যায়।এখন এটি মানুষকে মেরে ফেলবে তা কিন্তু নয়, কিন্তু তা সত্বেও কেও দুষ্টুমি করে মার্কেটে ছেড়েছে এমন কথা লোকে বলছে কেন? আমার মনে হয়, অনেকে বলছেনও তা, এটা দুর্ঘটনাবশত বাইরে এসেছে। অর্থাৎ এটি আন্ডার প্রিপারেশন অস্ত্র।তৈরি হতে হতে দুর্ঘটনাবশত হয়তো বাইরে বেরিয়ে গেছে। তাই পুরোপুরি যে চিন নির্দোষ তা আমার মনে হয় না। আবার চিনের ওই ল্যাবকে যারা ফান্ডিং করছিলো যেমন আমেরিকা, ফ্রান্স, কানাডা তারাও যে পুরোপুরি নির্দোষ তা বলা যায় না।
এখন এই ভাইরাস বাইরে বেরিয়ে বিভিন্ন দেশের লোকজনের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লো। থাইল্যান্ড থেকে কিছু লোক ভারতে এলেন। তাদের অনেকে নিজামুদ্দিনে গেলেন, তারাওতো তখনও জানেন না যে তাঁরা করোনা ভাইরাস বহন করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পনের থেকে ষোলো লক্ষ লোক লকডাউনের আগে ভারতে প্রবেশ করলেন। তারা দেশে প্রবেশের সময় ভালো করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু তা সম্ভবত করা যায়নি। কারও শরীরে করোনা প্রবেশ করলে জ্বর ইত্যাদি লক্ষন প্রকাশ পেতেতো চৌদ্দ দিন সময় লাগবে। তবে করোনা আছে কিনা তা ধরতে হলে একমাত্র উপায় হলো আর টি পি সি আর পদ্ধতির পরীক্ষা। আর টি পি সি আর টেস্টে ভুল হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। করোনা থাকলে ধরা পড়বেই। এছাড়া এলাইজা পদ্ধতি আছে। কিন্তু তাতে ভুল হতে পারে। তবে আর টি পি সি আর টেস্টের প্রযুক্তি অনেক ব্যয় সাপেক্ষ। আমাদের দেশের সরকার প্রাথমিকভাবে আর টি পি সি আর পদ্ধতিতে টেস্ট না করে বাইরে থেকে আসা লোকজনের দৈহিক তাপমাত্রা মেপেছে রোগ ধরার জন্য। কিন্তু থার্মাল গান টেস্ট করেতো সবসময় রোগ ধরা পড়ে না, ফলে রোগ ছড়িয়েছে । অনেককে কোয়ারান্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে। সবাই সেই নির্দেশ মেনে কোয়ারান্টাইনে থাকেনি। লক্ষন প্রকাশ না হওয়ায় কেও করোনা নিয়েই এদিক ওদিক পার্টিতে গিয়েছেন, কেও চা এর দোকানে আড্ডা দিয়েছেন, বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছেন। ফলে হু হু করে করোনা ছড়িয়েছে ভারতে। এখনতো কম্যুনিটিতে তা প্রবেশ করছে।
ভাইরাসটি তিন থেকে চার শতাংশ লোককে মারতে পারে। তবে এত ভয় কেন?ভয় হলো কোনো মানুষের শরীরে যদি আগে থেকে কোনও রোগ থেকে থাকে। সেক্ষেত্রে এই ভাইরাস মারাত্মক ভয়ের কারন হয়ে ওঠে। যাদের প্রেসার রয়েছে, যারা ডায়াবেটিস আক্রান্ত তাদের কাছে বিরাট ভয়ের কারন। ভারতবর্ষতো ডায়াবেটিস রাজধানী। এখনও প্রচুর ডায়াবেটিস রোগী অচিহ্নিত অবস্থায় আছেন। ভারতে এত ডায়াবেটিস রোগী থাকার পিছনে অবশ্য কিছুটা জেনেটিক কারনও রয়েছে। এখন বিষয়টি হলো যারা হাইপারটেনশনের রোগী বা যারা ডায়াবেটিক তাদের ফুসফুসে রেসেপটর প্রোটিন বেশি তৈরি হয়। একরকম এনজাইম বেশি থাকে। এনজাইমটির নাম হলো, এ সি ই টু বা এনজিওতেনসিন কোনভারটিং এনজাইম টু। এই এনজাইমের গায়ে করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন সহজেই শক্ত ভাবে বেঁধে যায়। ফলে ডায়াবেটিস আক্রান্তদের ও প্রেসারের রোগীদের নিয়ে চিন্তা বেশি। এছাড়া যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধক শক্তি কম তাদের নিয়েও চিন্তা রয়েছে। এখন কোনও যুবক করোনায় আক্রান্ত হলে সে তো চৌদ্দ দিন না গেলে বুঝবেই না তার মধ্যে করোনা প্রবেশ করেছে। তাছাড়া যুবক হওয়ায় রোগ প্রতিরোধক শক্তি বেশি থাকাতে সে করোনার সঙ্গে ভালো ফাইট দিতে পারবে। কিন্তু সে তো নিজের অজান্তে বাড়ির বয়স্ক মানুষদের মধ্যে সহজেই করোনা ছড়িয়ে দিতে পারে। এখন এই বয়স্কদের মধ্যে কেও ডায়াবেটিস রোগী থাকলে তার সংক্রমন ভয়ানক হয়ে উঠছে। বা যার রোগ প্রতিরোধক শক্তি কম তার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠছে যে ভেন্টিলেটর প্রয়োজন হয়ে পড়ছে।
এখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, এই যে চার থেকে পাঁচ শতাংশ করোনায় মারা যাচ্ছে তা আর এমনকি। পথ দুর্ঘটনায়তো অনেক লোক মারা যায়। তা ঠিক। কিন্তু কারও মৃত্যুর সময় না হলেতো তার মৃত্যু কামনা করা ঠিক নয়। ডায়াবেটিস আক্রান্ত, হাইপারটেনশনের রোগী বা রোগ প্রতিরোধক শক্তি কমে যাওয়া সব বয়স্ক মানুষেরই বাঁচার অধিকার রয়েছে। আর একটি কথা ১৩০ কোটির দেশে এই চার পাঁচ শতাংশ করোনায় আক্রান্ত হওয়া বা তাদের মৃত্যু হলে সংখ্যাটি বিরাট। অত লোক করোনায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য অত ডাক্তার, নার্স, বেড, হাসপাতাল, ভেন্টিলেটর কোথায়? পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এতে ভেঙে পড়বে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে অন্য রোগ ব্যাধির চিকিৎসা, প্রসূতির প্রসব এগুলো সব হবে কি করে? একটা ভয়ানক বিপর্যয়। সেকারণেই আজ করোনা ঠেকাতে এত লকডাউন বা সতর্কতা।
তবে একটি বিশেষ ইতিবাচক কথা বলি। ১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারতবর্ষে কিন্তু ধারাবাহিকভাবে বি সি জি টিকা দেওয়া হচ্ছে। শতকরা ৯৯.৯ শতাংশ মানুষ বি সি জি টিকা নিয়েছেন। বিসিজি টিকার ভালো গুন হলো, এটি শরীরে বহু রোগ সংক্রমন আটকে দেয়। ফলে বিসিজি টিকার সুফলের জেরে ভারতবর্ষ আমার মনে হয়, করোনা যুদ্ধে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। বিসিজি ভালোমতো হওয়ায় রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা অনেকের মধ্যে বেশ ভালো।
এখন বলছি ভ্যাকসিনের কথা। এরকম ভাইরাস বিরোধী ভ্যাকসিন আনতে কমপক্ষে দেড় বছর সময় লাগে। যদি উচ্চ প্রযুক্তিও প্রয়োগ করা হয় তবুও ছয় থেকে আট মাস সময় লেগে যায়। এখন ভ্যাকসিন এলেই সবাই তা সঙ্গে সঙ্গে নিতে শুরু করবে তাও কিন্তু নয়। আমাদের দেশে পোলিও ভ্যাকসিন প্রথমে আসার পর সবাই কিন্তু নিতে চায়নি। অনেক প্রচার সচেতনতা চালাতে হয়েছে এবং হচ্ছে সরকারকে। করোনার ভ্যাকসিন এলে প্রথমে কিছু মানুষ তা নিতে ভয় পেতে পারেন। কেননা তারা ভাবতে পারেন, ভ্যাকসিনও রোগ ডেকে আনতে পারে, ভাইরাসেরই অংশ ভ্যাকসিন। আবার ধরুন বিসিজি ভ্যাকসিন ষাট থেকে সত্তর শতাংশ ক্ষেত্রে কাজ করছে। বাকি ত্রিশ শতাংশ ক্ষেত্রে কাজ করছে না। এখন কোন ত্রিশ শতাংশের মধ্যে বিসিজি কাজ করছে না তা জানা নেই। এসব ভাবতে ভাবতেই কিন্তু করোনা ছড়িয়ে যাচ্ছে। অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থও হচ্ছেন। এরপর এমন একটি পৃথিবী আসবে যখন সবাই করোনা প্রতিরোধী শক্তি অর্জন করবেন। যারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে যুদ্ধে হেরে বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে, তারাতো চলেই গেলেন। বাকি মানুষেরাা কিন্তু করোনা রেসিস্টান্ট হয়ে যাবেন। তাদের ক্ষেত্রে বলা যায়, ডারউইনের যোগ্যতমের উদবর্তন তত্ত্বের কথা। যারা আজ বেঁচে যাবেন তাঁরা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে বেঁচে থাকবেন। আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে তাঁরা সবাই করোনা রেসিস্টান্ট হয়ে যাবেন।
এখন আসুন রোগ প্রতিরোধক শক্তির কথায়। আপনার যদি আজ চল্লিশ বছর বয়স হয় তবে আপনি আপনার উচ্চতা বাড়াবেন কি করে? কিছু বিষয় আছে তাহলো রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা মায়ের গর্ভেই তৈরি হয়। জেনেটিক্যালি আমরা সেই রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছি। আপনি এখন শুধু প্রোটেকশন নিতে পারেন। তবে বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকেই বলছি, করোনা যুদ্ধে জয়ী হওয়ার ভাবনায় ফুসফুসের কিছু ব্যায়াম করতে পারেন। যেমন প্রাণায়াম।আমাদের ফুসফুসের একশ শতাংশ অংশ কখনোই কাজ করে না । এখন এমন সব ফুসফুসের ব্যায়াম করা যায় যাতে ফুসফুস ভালো থাকে। তার সঙ্গে কিছু পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া যেতে পারে। এমন কিছু ব্যায়াম বা আসন করা দরকার যাতে মানসিক অবসাদ বা হতাশা কমে। মানসিক অবসাদ বা হতাশা কিন্তু শরীরের রোগ প্রতিরোধক শক্তিকে দুর্বল করে তোলে। তাই করোনা বিরোধী যুদ্ধে জয়ী হতে অবসাদগ্রস্ত হলে চলবে না।
আর এখন লকডাউন অবশ্যই মেনে চলা উচিত। মাস্ক একদম বাধ্যতামূলক। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আবার কিন্তু করোনার একটি ওয়েভ ফিরে আসার সম্ভাবনা। মাস্ক আগামী দেড় বছর পড়তেই হবে। আর হাত স্যানিটাইজ করা, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এসব এখন প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠুক। ”