কানাডার স্মৃতি নিয়ে কাজরী বসু

শিল্পী পালিত ঃ খবরের ঘন্টার এই ওয়েবপোর্টালে কানাডা ভ্রমণের স্মৃতি মেলে ধরলেন লেখিকা কাজরী বসু। সুন্দরভাবে তিনি বিস্তৃত করেছেন কানাডা পর্ব ১। ধন্যবাদ তাঁকে—

কানাডা…পর্ব ১
কাজরী বসু
কানাডার কথা শুধু মনেই পড়ে না, চার বছর আগের কথা হলেও মনে হয় কালই ঘটেছে। আমার তো পাঁচ মাসের সেই কানাডাবাসের প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহূর্তের কথাই মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে। সেই অর্থে বিদেশ বলতে যা বোঝায়,আমি একবারই গিয়েছি,আর সে যাওয়াও পছন্দের নয়,প্রয়োজনের বাটন প্রেস করে। কিন্তু প্রয়োজন পছন্দে পরিণত হতে দেরি হয়নি।

বিভিন্ন ব্যথাজনিত সমস্যা নিয়ে এত বড়ো একটা যাত্রাপথ একা কিভাবে সামলাব তা নিয়ে অবশ্য সংশয় ছিল অনেকেরই।আসলে লোকজনের দোষ নেই ,কলকাতায় পর্যন্ত একা ট্রামে বাসে চলাফেরার অভ্যেস বহুদিনই যার নেই,সে একা লটবহর নিয়ে কিভাবে এতখানি পথ পাড়ি দেবে,সে এক প্রশ্ন বইকি।কনফিডেন্ট ছিলাম একা আমি,কারণ,আমি অত ভাবিইনি।কারণ আমার এত ভাবার স্বভাবই নয়।ভেবে তো আসলে কিছুই হয়না।মানুষ একরকম ভাবে,হয় আর একরকম।পৃথিবীর এটাই নিয়ম।

তো যাই হোক,ফ্লাইটের একটা সুবিধে থাকে,চাইলে হুইলচেয়ার পাওয়া যায়।আর সেটা শুধু গ্রন্থিসমস্যায় জর্জরিত লোকেদের হাঁটার সমস্যা লাঘবই করেনা,তা বিভিন্ন এয়ারপোর্টে গিয়ে কোথায় যাব কি কিরব কোনদিকে প্লেন দাঁড়াবে ইত্যাদি প্রভৃতি সমস্যারও নিশ্চিত সমাধান,এ তো নিয়মিত হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীরা জানেন।আমাকে অবশ্য বলা হয়েছিল আমেরিকান ডলার রাখতে,হুইলচেয়ার বহনকারীদের দেবার জন্য,কিন্তু কার্যত কাউকেই কিছু দেবার সুযোগই ছিলনা।যিনি রেখে যান,পরে এসে আর একজন নিয়ে যান।কাকে কি দেব ভাবার আগেই প্লেনের পেটের মধ্যে সুড়ুৎ করে ঢুকে যাওয়া।কলকাতা থেকে ড্রাগন এয়ারের একটা ছোট বিমানে হংকংয়ে এসে কানেকটিং ফ্লাইট ক্যাথে প্যাসিফিকের, হংকং থেকে সোজা টরন্টোর পিয়ার্সন এয়ারপোর্ট। হংকংয়ে পৌঁছে দেখি ফোনে চার্জ নেই,আর চার্জার পয়েন্ট হলো ইউরোপিয়ান মডেলের।আমাদের চার্জার সেখানে ঢুকবেনা।এবার খবরাখবর দিই কি করে!একেই একা বেরিয়েছি পথে,সবাই টেনশনে কাঁপছে।

এয়ারপোর্টে গোটা চারেক কম্পিউটার। হাতে দু ঘন্টা মতো সময়।ভাবলাম, দেখি ফেসবুক লগইন হয় কিনা।তো,সেখানে দেখি চীনা ভাষায় সব কিছু।একটি চাইনিজ মেয়ে ফেসবুকে ব্যস্ত,তারই শরণাপন্ন হলাম।সব জায়গায় মানুষ কিভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়,তা তখন থেকেই বোঝার শুরু।আমাদের এ দেশেও হয়ত করে লোকজন এই সাহায্যটুকু।আমার অভিজ্ঞতা কম।
মেয়েটি আমায় ইংরেজি মোডে কম্পিউটার এনে দিয়ে নিজে উঠে চলে গেল।দিব্যি ফেসবুকে লগইন করে মেয়েকে আর বরকে ইনবক্সে জানালাম আমার তৎকালীন স্থিতি ।এখানে তখনও সকাল হয়নি।মেয়ের টরন্টোয় সম্ভবত রাত তখন।
ফেসবুক টাইমলাইনেও একখানা বার্তা দেওয়া থাকল,আমি রাস্তায় বেরিয়েই হারিয়ে যাব,এমন একটি অনাস্থা মনে মনে যারা পোষণ করেছিলেন,সেই সব শুভাকাঙ্ক্ষীর জন্য।

যথাসময়ে দ্বিতীয় হুইলচেয়ার বহনকারী এসে প্লেনের পেটে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলেন।আসন ছিল সাইডের,যাকে বলে আইল সিট,চীনা বিমানসেবিকারা আমন্ত্রণ জানালেন, পাশাপাশি দুটি সিটের একটিতে এক বিদেশিনী।একা বিমানযাত্রা।থ্রিলিং ইনডিড।মাটি ছেড়ে শুরুতেই আমার নিজস্ব কাজকারবার শুরু হল,এক গ্লাস জল টাল সামলাতে না পেরে ফেলে দিলাম সেই বিদেশিনী ভদ্রমহিলার চাদরে।কেলেঙ্কারির আর বাকি কি রইল!

জানিনা এঁরা কি দিয়ে তৈরি হন।কিছু বলা তো দূরস্থান, বিরক্তিতে ভুরুটুকুও কুঁচকে গেলনা।সেই পরিস্থিতিতে উনি কিছু বললে আমি অন্তত দোষ স্বীকার করেও শান্তি পেতাম।নিঃশব্দ ক্ষমার একটা মুশকিল যে,নিজের ভুল স্বীকার করারও পরিসর থাকেনা,আর নিজেকেই মরমে মরে যেতে হয়।
ভদ্রমহিলা চাদরটা চেয়ারের একপাশে কিভাবে যেন একটুখানি মেলে দিলেন। কোনোরকমে একটা ‘সরি’ বললাম,উনি মুখে একটু হাসির ভাব এনে যেমন বই পড়ছিলেন পড়তে থাকলেন।
কোথাও যাওয়ার প্রধান শর্ত যে সাবধানতা,সেই শিক্ষা গেঁথে গেল মনের মধ্যে।

–কাজরী বসু, ই সি টি পি,ফেজ ওয়ান,অপোজিট রুবি হসপিটাল, ইস্টার্ন বাইপাস