গান,গান আর গানের সঙ্গে জয়তিদেবীর প্রেম লেখালেখিতে

শিল্পী পালিত ঃ আজ আমাদের আত্মকথা বিভাগে সঙ্গীত শিল্পী জয়তি ভট্টাচার্যের কথা মেলে ধরা হচ্ছে। খুব সুন্দর করে তার কথা লিখেছেন জয়তিদেবী। চলুন তার কথা মন দিয়ে পড়ি–

নয় নয় করে জীবনের অনেকগুলো বছর পার করে ফেললাম । এবার মনের গভীরে তাগিদ অনুভব করছি নিজের কথা লেখার। আমার শৈশব, কৈশোর , আমার গানে গানে খেলাধুলোয় আদরে ভালোবাসায় ফুলের মত বিকশিত হওয়ার কথা স্মৃতিরোমন্থনের ছলে বলতে ইচ্ছে করে ! সুন্দর ছিল সেই দিনগুলি,বড় সুন্দর ! কোনও তিক্ততা ছিল না, ছিল না কোনও জোর জবরদস্তি ! আমি, আমার ছোটো ভাই , মা আর বাবা, এই নিয়ে ছিল সুন্দর ছোটো সংসার ! স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে মনিমেলায় খেলতে যাওয়া, খেলে ফিরে গান, নাচের চর্চা , তারপর পড়তে বসা, নিয়মবদ্ধ দিনগুলি কাটত মাখনের মত মসৃণ ! রাগারাগি নেই, নেই কোনও বকাঝকা !
খড়দার বি টি রোড আর গঙ্গার মাঝে লিচুবাগান নামের একটা নিরিবিলি শান্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ছিল আমাদের বাড়ি, আমার বাবা মায়ের অনেক স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা ছবির মত সুন্দর একটা বাড়ি আমার চোখের সামনে একটু একটু করে গড়ে উঠেছিল ! বাগান দিয়ে ঘেরা সেই বাড়িতে ফুটত কত রকমের ফুল । ছিল নারকেল গাছ, গাছ ভরতি পেয়ারা , সেই পেয়ারার লোভে আসত ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া পাখি ! বাড়ির পিছনে পুকুরে চরে বেড়াত হাঁসের দল ! ছুটির দিনের সকাল কাটত লজ্জাবতীর পাতাগুলোকে লজ্জা পাইয়ে, স্থলপদ্ম গাছের ভোর বেলায় ফুটে ওঠা সাদা ফুল কখন কিভাবে গোলাপি হয়ে যায় সেই দেখে, টুয়েলভ ও ক্লক ফুল ঠিক বেলা বারোটায় সত্যি ই ফুটে ওঠে কিনা তাই দেখে ! শেষে বাবা হাঁক দিতেন, ”এই পাগলী ! ঘরে আয় ”! ডাকনাম ছিল মম, বাবার মুখে সেই নাম ছিল পাগলী !
কোনো আরোপিত বন্ধন ছিল না, স্নেহের বন্ধন ছিল একমাত্র শৃঙ্খল ! শান্ত শিষ্ট মেয়ে হিসেবে আমার খ্যাতি ছিল , মা বাবা দুজনেই ছিলেন স্কুল শিক্ষক , তাই লেখাপড়ায় কখনো প্রাইভেট টিউটরের কাছে যেতে হয় নি ! পড়াশোনার পাশাপাশি একমাত্র নেশা ছিল গান গান আর গান ! গান শিখতে শুরু করি খুব ছেলেবেলায় শ্রীমতি মীরা মুখোপাধ্যায়ের কাছে, তিনি ছিলেন শ্রীমতি সুচিত্রা মিত্রের স্নেহধন্যা ছাত্রী ! প্রথম দিনের প্রথম গান শিখেছিলাম , ”দুরদেশী সেই রাখাল ছেলে” । ছেলেমানুষি বোধবুদ্ধি দিয়ে সেই গানের মর্মকথা কতটুকু বুঝেছিলাম মনে নেই, শুধু এইটুকু পরিষ্কার মনে আছে , আমার গানে গানে পথ চলায় রবিঠাকুর এসে আমার হাতটি ধরলেন, আমার ছেলেমানুষি দিয়েই বুঝে নিলাম, সারা জীবনের সুরের পথ চলার পাথেয় হল রবি ঠাকুরের গান !
পড়াশোনার পাশাপাশি চলল গানের তালিম , উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিমের জন্য শ্রীদেবশঙ্কর ভট্টাচার্য এবং শ্রীমতি কল্পনা মুখোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে এলাম ! তালিমের পাশাপাশি উৎসাহ দানের মাধ্যমে গতিবর্ধক ভূমিকা পালন করতেন আমার মা শ্রীমতি শান্তি দাস,মাসি শ্রীমতি লাবণ্য চক্রবর্তী এবং মাসতুতো দাদা শ্রী লোকেশ ভট্টাচার্য ! এই তিনজন আমার হাতটি ধরে না থাকলে আমার আজ কোথাও পৌছনো হত না, কেউ আমাকে চিনত না ! ওনারা পাশে না থাকলে আমি নিজেকেই কি চিনতাম যাঁদের সান্নিধ্যে এসেছিলাম , অনেক পরে, তাঁরা হলেন শ্রীমতি পূর্বা দাম এবং শ্রীমতি প্রমিতা মল্লিক !
এনাদের আশীর্বাদ আর শ্রোতা বন্ধুদের ভালোবাসা আমাকে অনেক দিয়েছে, ” দিয়েছি যত নিয়েছি তার বেশি ” । এই ভালোবাসা পাথেয় করেই সুরের পথে হেঁটে চলেছি জীবনভর, সারাজীবন এই সফর চলতেই থাকুক ! এইটুকুই প্রার্থনা ! সুরই যেন আমার সারা জীবনের সাথী হয় ! আর মাথায় হাত রাখুন রবি ঠাকুর !
প্রথম প্রেম গান, দ্বিতীয় ভালোবাসা জীবনসঙ্গী শ্রী সুজিত ভট্টাচার্য, জীবনের পথ চলার প্রতিটি পদক্ষেপে তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া কিছুই সম্ভব হত না সে কথা কি আর আলাদা করে লেখার অপেক্ষা রাখে ! এর পরেও , অনেক বেলা করে আমার জীবনে এসেছে আর এক প্রেম, দেরি করে এলেও বেশ জোরের সঙ্গেই এসে হাজির হয়েছে আর জুড়ে বসেছে আমার অনেকটুকু ! সেই প্রেম হল আমার লেখালেখি , আমার সাহিত্য চর্চা আমার কবিতা গল্প প্রবন্ধ ! এরা সব এসেছে আমার বেলাশেষের গান হয়ে ! আমার এই গান, লেখালেখি নিয়ে আমি বেশ আছি কিন্তু , বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমার গল্প কবিতা প্রকাশ হয় ! অরা আলোর মুখ দেখলে আমার নিজের মুখটাই আলোয় উজ্বল হয়ে ওঠে ! বড় ভালো লাগে !