শাল ডুলুংয়ের মায়ামাখা জঙ্গলে

শিল্পী পালিতঃ আজ হুগলি থেকে পাঠানো শ্রাবনী সামন্তের একটি ভ্রমন কাহিনী প্রকাশিত হলো —

শাল_ডুলুংয়ের_মায়ামাখা_জঙ্গলে

দিনটা ছিল রোববার। সক্কাল সক্কাল চড়েছিলুম টাটাসুমোয়। চাঁপাডাঙ্গা, পুরশুড়া, উদয়নারায়ণপুর, আমতা হয়ে বহু চেনা- আধাচেনা পথ পাড় হয়ে NH-6 ধরে কোলাঘাট। কিছুক্ষণের পূর্ণচ্ছেদ, শের-ই-পাঞ্জাবে জলখাবার, দুই বিচ্চুকে(টিনটিন, তীর্থ) নিয়ে মজা, খুনসুটি মনে থাকবে অনেকদিন। তারকেশ্বর থেকে ১৭৪ কিমি পথ উজিয়ে ঝাড়গ্রাম পৌঁছাতে বেলা এগারোটা বাজলো। তা বাজুকগে, মনে মনে তখন আমি….এই আকাশে আমার মুক্তি…!!ইতিমধ্যে খড়গপুর চৌরাস্তার মোড় থেকে রূপকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অভিজিৎদার যোগদানে আমাদের আনন্দ আর এক কাঠি বেড়েই গেলো।

একটানা চলেছি ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে, এমন পরিবেশে দিনযাপন বড় মোহময়। শাল-পিয়ালের মাঝে রৌদ্র-ছায়ার মায়া খেলা, মাথার ওপর নীল আকাশ আর সবুজের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, “কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা”। মনে হচ্ছে কতদিন সবুজ প্রান্তরে পা রাখিনি।প্রকৃতি যেন ঢেলে সাজিয়েছে তার এই মানসকন্যাকে। গহন অরণ্য,গাছ-গাছালির সঙ্গে হাওয়ার সখ্যতা….যেন সবুজ রূপকথার দেশ। চলতে চলতে মনে হয় বাংলায় কী নেই! প্রকৃতি তো উজাড় করে দিয়েছে তার সবটুকু আমাদের এই বঙ্গভূমিকে! পাহাড়, নদী,ঝর্ণা, সমুদ্র, জঙ্গল, বিস্তীর্ণ তরাই, শস্যশ্যামলা গ্রাম, বলে শেষ করা যাবেনা।

যাইহোক প্রথম দর্শনে যাওয়া হল সোজা “ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি”। এর পিছনে রয়েছে ইতিহাসের গন্ধ! রাজস্থান থেকে রাজা সর্বেশ্বর সিং চৌহান বাংলা জয় করতে এসে “ঝাড়িখণ্ড”য়ের মাল শাসককে পরাজিত করেন।”মল্লদেব “উপাধি ধারণ করে যে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন তার রাজধানী ঝাড়গ্রাম। প্রায় ৪০০ বছর ধরে ১৮ জন রাজা এই রাজত্বে রাজকার্য পরিচালনা করেছেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ঝাড়গ্রাম রাজপ্রাসাদ ইউরোপিয় ও মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের সংমিশ্রনে তৈরি হয়। বর্তমান রাজ পরিবারের সদস্যরা প্রাসাদে বাস করেন। প্রাসাদের নিম্নতল হেরিটেজে পরিবর্তিত হয়েছে। যা ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন ও বর্তমান রাজ পরিবারের যৌথ পরিচালনায় চালিত হয়।

এরপর চললাম ঝাড়গ্রাম থেকে ১৫ কিমি. দূরে #চিল্কিগড়। গড় আর কনকদুর্গার মন্দিরের জন্য এর খ্যাতি। মন্দিরের চারপাশে ৬৪ একর এলাকা জুড়ে রয়েছে সবুজ মনোরম অরণ্য। শাল, মহুল, কেঁদ, অশ্বত্থ, হরিতকী,রুদ্রাক্ষ, হাড়ভাঙা,বহেড়া এবং আরো দুষ্প্রাপ্য শত শত গাছেরা স্বাগত জানায়। প্রায় ১০৮ রকম ভেষজ গাছ রয়েছে। অশেষ তাদের ওষধি গুণ!! তির তির করে বনের ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে #ডুলুং।বর্ষায় এর রূপ নাকি ভয়ংকর হয়। শীত-গ্রীষ্মে তার ছলছলে শরীরে গোড়ালি জল।

ডুলুং নদীর ধারে প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো #কনকদুর্গার মন্দির। বেশ ভগ্ন অবস্থা। গা ছমছমে পরিবেশ। মন্দিরের দেওয়াল মাঝখান দিয়ে ফেটে গেছে। বেশিদিন হয়তো থাকবে না। কালের মন্দিরা বাজতে শুরু করেছে। অতীতে নাকি এখানে নরবলিও হতো।

মন্দিরের পার্কিং এলাকায় গাড়ি রেখে টিকিট কেটে মন্দির দর্শন করতে রওনা হলাম। টিকিট কাউন্টার থেকে মন্দির পর্যন্ত নয়নাভিরাম আরণ্যক পথে হেঁটে চলা মন্দির দর্শনের উপরি পাওনা। প্রায় ৫০০ মিটার অপূর্ব বনপথে হেঁটে বাঁক নিতেই চোখে পড়ে মন্দির। পুরনো জীর্ণ মন্দিরের পাশেই নতুন আটচালায় দেবীর নিত্যপূজা, চাইলে ভোগও মেলে। সরকারী উদ্যোগে প্রমোদ উদ্যান, জঙ্গলের ভিতর খালে বোটিং – নিয়ে যাবে অন্য জগতে।

স্বর্ণদুর্গা থেকে কনকদুর্গা নাম। গল্প আছে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি চিল্কিগড়ের সামন্ত রাজা গোপীনাথ সিংহ মত্তগজ স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তাঁর তিন রানির হাতের কঙ্কন দিয়ে তৈরি করেন দেবী কনকদুর্গার মূর্তি। দেবী চতুর্ভূজা, অশ্ববাহিনী। সালঙ্কারা দেবীর অঙ্গে নীলবস্ত্র। ১৯৬০ সালে এ মূর্তি চুরি যায়।১৯৯৬ সালে অষ্টধাতুর (রেপ্লিকা) কনকদুর্গা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাতেই এখন পুজো চলছে।

মন্দির চত্বরে অগুনতি বাঁদরের লাফালাফি। বাঁদরকুলের দৌরাত্মে অসাবধানতাবশত খোয়া যেতে পারে পুজোর ডালা। শান্ত পরিবেশে মন্দিরে পুজো দিয়ে দুদন্ড জিরিয়ে নিতেই দু’চোখ জুড়ে দুনিয়ার ঘুম নেমে আসে। কিন্তু সময় কোথায়! রূপকের ডাকে সম্বিৎ ফিরলো, সবাই চললাম দুপুরের খাওয়া সারতে। মন্দিরের গাড়ি পার্কিং এলাকাতেই মধ্যাহ্নভোজের সুবন্দোবস্ত। খাওয়া সেরে আবার বনবীথির ছায়ায় ক্ষনিকের বিশ্রাম আর সকলে মিলে একের পর এক বিভিন্ন স্বাদের আইসক্রিম খাওয়া চললো। কিন্তু পরের গন্তব্যে রওনা দেবার সময় হয়ে গেলো যে…….

পরবর্তী গন্তব্য ডুলুংয়ের ওপারে #চিল্কিগড়_রাজবাড়ি। দুর্গ হলো গড়। সেইকারণেই এই নাম। জয়ন্ত ধবলদের তৈরি প্রায় ৭০০ বছরের পুরনো চিল্কিগড় রাজবাড়ির বিশাল প্রান্তরে এসে দাঁড়ালাম। এই রাজবাড়ির শেষ রাজা ছিলেন জগদীশ চন্দ্র। সেটা ছিল ১৯৫৩ সাল। মাঠের প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকেই বাঁদিকে সুপ্রাচীন বটগাছ এবং একরত্ন শিব মন্দির (শিখর দেউল) ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। মাঠের একপ্রান্তে পুরনো রাজবাড়ি।জামবনি এলাকায় এই রাজবাড়ি, ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির মত সুন্দর না হলেও সময়ের ছাপ আর রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে এর একটা ভিন্ন রূপ প্রকাশ পাচ্ছে।

দিনটা রবিবার হওয়ায় অনেক কিছু দর্শন থেকে বঞ্চিত হলাম। কি আর করা…. ফিরে চললাম, বিখ্যাত #লোধাশুলির জঙ্গলকে সাক্ষী রেখে। পিছনে রয়ে গেলো বুনো গন্ধ, পাখিদের সংসার, প্রজাপতিদের আনাগোনা। বুক ভরে অক্সিজেন নিয়ে ফিরতে ফিরতে বললাম ফের দেখা হবে। বাকি রয়ে গেছে যে অনেক কিছু। সব অনুভূতিটুকু নেবার সময় আর ছিলনা। জাতীয় সড়কের ধারে পড়লো #মা_গুপ্তমনির মন্দির, সেখানে প্রণাম জানিয়ে ফিরে চললাম আবার সেই গতানুগতিক জীবনে।।।।।।।।।

।সমাপ্ত।।।।।।

Srabani Samanta.
Hooghly