জলমগ্ন জম্বুদ্বীপ

শিল্পী পালিতঃ সকলকে শুভ রথযাত্রার শুভেচ্ছা। সকলে ভালো থাকুন। সবাই মেনে চলুন করোনা সচেতনতা। সকলের কাছে অনুরোধ, খবরের ঘন্টার এই ওয়েবপোর্টাল এর বিভিন্ন পোস্টগুলো শেয়ার করে আপনারা এই ওয়েবপোর্টালকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করুন। আজ হাওড়ার ক্ষমা রায় ভট্টাচার্যের এই ভ্রমণের লেখা প্রকাশিত হলো।

জলমগ্ন জম্বুদ্বীপ
✍️ Kshama

বেনফিসে পৌঁছে দেখলাম জেটি সরগরম । ট্রলারের পর ট্রলার এসে থামছে ভর্তি ভর্তি বিভিন্ন রকমের মাছ নিয়ে । মুহূর্তে সরগরম হয়ে উঠছে জেটি ।‌ লোকজনের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম বড় বড় ঝুড়ি ভর্তি মাছ নামছে ট্রলার থেকে । কোথাও আবার জাল থেকে মাছ ছাড়াচ্ছে । পমফ্রেট, ছুরি, ইলিশ(খুব অল্প), রূপচাঁদা, লইট্যা, টুনা এই মাছগুলোই চিনতে পারলাম ।

কিছুটা সময় পর একটা বড় ট্রলার লঞ্চে বেশ কয়েকজন যাত্রীর সাথে আমরাও জম্মুদ্বীপের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম । ভিতরে বসার জায়গা থাকলেও সারেঙের অনুমতি নিয়ে আমি আর আমার ছেলে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলাম । খোলা জায়গা থেকে ভালো দেখা যাবে । আমাদের দেখাদেখি আরও কয়েকজন উঠে এলো ।

সারেঙ বললো , “নৌকা দুলবে , বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে যেতে পারবেন না ।” বলে একটা প্লাস্টিক সীট বিছিয়ে আমাদের বসে পড়তে বললো ।

#এডোয়ার্ড ক্রিক এর মধ্যে দিয়ে পাতানিয়া জঙ্গল(এটাও একটা দ্বীপ) ডানপাশে নিয়ে লঞ্চ এগোতে থাকলো । লঞ্চের বাঁদিকে কাছাকাছি ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় দু’একজনকে মাছ ধরতে দেখা গেল । ডানদিকে পাতানিয়া জঙ্গলের পারে জলের পার থেকে পোকা খেতে দেখা গেল কয়েকটি বককে ।

আস্তে আস্তে খাঁড়ি ছাড়িয়ে লঞ্চ গিয়ে পড়লো অথৈ জলে । আরেব্বাস ! কী ঢেউ এখানে ! ওরে বাবা ! লঞ্চ তো মোচার খোলার মতো দুলতে লাগলো । রেলিঙটাকে শক্ত করে ধরে বসে রইলাম । অনন্ত জলরাশি সামনে । মনে হচ্ছে সাগরে এসে পড়েছি । সারেঙের সহকারী ছেলেটি বললো “না , বুড়িগঙ্গার মোহনায় এসে পড়েছি ।”

এই মোহনা ! এত ঢেউ ! লঞ্চ এত দুলছে ভয়ও লাগছে আবার মজাও লাগছে । পাঁচটা ধপধপে সাদা সীগাল দেখে হাঁস ভেবেছিলাম, ঢেউএর মাথায় বসে নেচে নেচে এগোতে লাগলো । আমরা মরছি ভয়ে আর ওদের কোনো চিন্তা নেই । দিব্যি জলকেলি করছে ।

লঞ্চ দুলতে দুলতে আমাদের নাড়িয়ে নাড়িয়ে এগোতে লাগলো আরো সামনের দিকে । পিছনে তাকিয়ে দেখি কোথায় বেনফিস ? সামনে পিছনে ডায়ে বাঁয়ে যেদিকেই তাকাই সাদা ফেনার অজস্র মুকুট আর জল । ডানদিকে মৌসুমি দ্বীপ নেই , বাঁদিকে ফ্রেজারগঞ্জ নেই …. ডাঙা বলতে শুধু জলের মাঝে একটা মোচার খোলার মতো লঞ্চ আর তাতে ভয়ার্ত কোলাহল মুখর কিছু নারীপুরুষ ।

তার মধ্যে মাঝে মাঝেই সারেঙের সহকারী ছেলেটি গম্ভীর মুখে নানারকম কায়দায় কখনও একদম ট্রলারের মুখের ছুঁচলো জায়গায় টাইটানিকের পোজ দিচ্ছে আবার ট্রলারের বাইরে দিয়ে স্পাইডারম্যানের মতো সামনে থেকে পিছনে চলে যাচ্ছে প্রায় জল ছুঁয়ে এক অদ্ভুত কায়দায় । হয়তো আমাদের মতো ভীত শহুরে মানুষদের ভয় থেকে বের করে আনার জন্যই ওর এই প্রচেষ্টা । নীচের কেবিন থেকে বমির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে । শুনেছি সমুদ্রে অনেকের এরকম হয় । সারেঙের সহকারী ছেলেটির নির্দেশ মতো অনেক দূরে একটা রেখা দেখতে পেলাম । ওটাই নাকি জম্বুদ্বীপ ।ওখানেই আমাদের আজকের গন্তব্য ।

ক্রমশ ঐ রেখাটা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে আস্তে আস্তে সবুজ জঙ্গলে পরিণত হলো । অনেকটা জল পেরিয়ে এসেছি । এখন পূর্ণ জোয়ার । তাই জম্বুদ্বীপ জলমগ্ন । শুধু গাছের মাথাগুলো দেখা যাচ্ছে । দ্বীপের ভিতরে হয়তো পশুগুলো নিরাপদেই আছে । শুনলাম এখানে অনেক শুয়োর দেখা যায় । আমরা জম্বুদ্বীপে নেমে ভিতরে যেতে পারবো না । সুপ্রিম কোর্টের নিষেধ আছে। তাই দ্বীপের সামান্য আগেই নোঙর ফেলা হলো । হয়তোবা এই জায়গাটা দ্বীপেরই অংশ । জোয়ারের জলে বোঝা যাচ্ছে না

এখানে বেশ কিছুক্ষণ কাটলো । শুনলাম কেন দ্বীপে যাওয়া নিষেধ ! ঐ ছেলেটির মুখেই শুনলাম আগে জম্বুদ্বীপে কিছুঘর বসতি ছিল । এখানে জেলেরা মাছ শুকিয়ে শুঁটকি করতো । তারপর বস্তাবন্দী করে ফ্রেজারগঞ্জে নিয়ে মহাজনদের কাছে দিত । এছাড়াও এখানে শুকর পালন হতো ।

সকালের নৌকায় ট্যুরিস্টরা এসে বিকেলের নৌকায় ফিরে যেত । কিন্তু মুম্বাই হামলার পর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এখানে বসবাস বন্ধ হয়ে গেছে । কারণ নৌকায় যদি কোনো টেররিস্ট দল তাদের অস্ত্রশস্ত্র এখানে লুকিয়ে রেখে পরে ভারতভুখণ্ডে হামলা করতে পারে । নৌকায় কে এলো কে ফিরে গেলো এত হিসেব রাখা মাঝি সারেঙদের পক্ষে সম্ভব নয় । তাই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এই দ্বীপ এখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক ঘাঁটি ।

কথা বলতে বলতে ট্রলারের মুখ ঘুরে গেল । আবার ইঞ্জিন চালু হলো । আমরা দুলতে দুলতে ফিরে চললাম ডেন্টিস্টের দিকে । জল থেকে ক্রমশ ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হলো ফ্রেজারগঞ্জ , পাতুনিয়ার জঙ্গল , এডোওয়ার্ড ক্রীকের ট্রলারের সারি । খুব ভালো লাগছিল পাতুনিয়াকে দেখে । যাকে দেখে মাত্রা শুরু হয়েছিল সে রূপ বদলে ফেলেছে । জল থৈ থৈ জঙ্গলে ম্যানগ্রোভের মাথাগুলো শুধু আমাদের ফেরার অপেক্ষায় জেগে আছে ।

© Kshama Ray Bhattcharyya
Howrah.