কবিতাকে আঁকড়ে ধরেই সময় পার করছেন শ্রীলেখাদেবী

শিল্পী পালিতঃ আজ আত্মকথা বিভাগে বিশাখাপত্তনমের শ্রীলেখা মুখার্জীর কথা মেলে ধরা হলো। কবিতা নিয়েই বেশ আছেন শ্রীলেখাদেবী। পড়ুন

একটি সাধারণ মেয়ের আত্মকথা

——————————————-

নিজের কথা লিখতে বসে, কোথা থেকে শুরু করবো, ভাবতে ভাবতে সময় পেরিয়ে যায়।

জন্মমুহূর্তের কথা তো মনে থাকার নয়। তবে মায়ের মুখে শুনেছি, এক ফাগুনী পূর্ণিমা রাতে আমার জন্ম। তবে সাইজে একরত্তি ছিলাম… মাত্তর দু’কেজি ওজন আর সময়ের আগেই পৃথিবীতে পদার্পণ। নিজের বর্তমান বপু দেখে, চিন্তাই করতে পারি না আমি জন্মমুহূর্তে দু কেজির ছিলাম। আমার ছোটমামা তো সন্দেহ প্রকাশ করেছিল আমার বাঁচা নিয়ে !

যাইহোক দিব্যি বেঁচে গেলাম। উত্তর কলকাতার এক রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়ে উঠতে লাগলাম। পরিবার মানে ছোটখাটো নয়… মস্ত পরিবার, প্রায় পঁয়ত্রিশজন সদস্য। খুব পুরোনো গলির মধ্যে ততোধিক পুরোনো তিনতলা একটা বাড়িতে বেড়ে উঠতে লাগলো আমার শৈশব।
ঠাকুমা ,জেঠু ,জেঠিমা ,জেঠতুতো দাদা, দিদি, বৌদিরা… আর প্রায় সমবয়সী ভাইপো ভাইঝিদের নিয়ে আমার মেয়েবেলার গল্প।

উত্তর কলকাতার যে অঞ্চলে আমি থাকতাম, সেখানে বিভিন্ন বারব্রত, পূজোপার্বণ খুব পালন করা হতো। আমাদের একটি শিবমন্দির ছিল, বাড়ির লাগোয়া। তাই বারোমাসে তেরপার্বণ লেগেই থাকত। জষ্ঠি মাস পড়লেই মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত, এছাড়া দোলযাত্রা, রথ, নীলষষ্ঠী, শিবরাত্রি, ইতুপূজো… কিছুই বাদ পড়তো না। মঙ্গলচণ্ডীর ব্রততে সকালে স্নান সেরে আমরা হাতে ফুল নিয়ে ঠাকুমার কাছে বসে পড়তাম। ঠাকুমা ব্রতকথা শোনাত… মন দিয়ে শুনতাম। কিন্তু কী উদ্দেশ্যে এই ব্রত অত বুঝতাম না। আমার একটাই উদ্দেশ্য ছিল ,ভালোমন্দ খাওয়া। সেদিন ভাতের বদলে ফলার খাওয়া হত… মুড়ি চিঁড়ে,মুড়কি,আম,দই সন্দেশ সব একসংগে মেখে ফলার তৈরী হত ! সে ছিল অতি উপাদেয় খাদ্য ! ছোট থেকে শিবঠাকুর আমার খুব পছন্দের… হয়ত অমন বেশভূষার জন্য। এখনকার ভাষায় , দেখার মতো গেট আপ, রকস্টার লুক !! তাই শিবরাত্রিও করতাম , আর উদ্দেশ্য সেই ভালোমন্দ খাওয়া!!

শুধু পূজোপাঠ করলেই তো হয় না, তাই যথাসময়ে স্কুলে ভর্তি হলাম। কলকাতার নামি স্কুল… বেথুনে ! বাবার অক্লান্ত পরিশ্রমে স্কুলের প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে বেথুনে ভর্তি হলাম। সে অন্য এক জগত ! একটাই সমস্যা ছিল, আমার পড়াশোনা করতে মোটেই ভালো লাগতো না। রোজ পড়াশোনা… ভাবলেই কান্না পেত। বাবার পিটুনিও খেতাম , পরীক্ষায় গোল্লা পাবার জন্য।

আসলে আমি, পাজি মেয়ে বলতে যা বোঝায় , তাই ছিলাম। গরমের ছুটি পড়লেই আমার দৌরাত্ম্যি আরও বেড়ে যেত। ভাইপো ,ভাইঝি ,বোনপো, বোনঝি সবাই মিলে দল বানিয়ে ফেলতাম আর পাণ্ডা ছিলাম আমি। মা দুপুর হলে মেরে ধরে নিজের কাছে শোয়াতো। আর আমি তক্কে তক্কে থাকতাম ,মা কখন ঘুমাবে। যেই ঘুমাতো, আমি দরজা খুলে হাওয়া ! তারপর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে কাজ ছিল গলিতে সবার বাড়ি কড়া নেড়ে পালিয়ে আসা। ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো, লাটাইয়ের সুতো ছাড়া ! বিকেল হলেই ছাদে পুরো গ্যাং কে প্যারেড করানো, ব্যায়াম করানো… কতো বলি আর !!

অনেক কিছু না পেয়েও বড়ো সুন্দর ছিল আমার শৈশব। ক্রমশ বড় হতে লাগলাম…কখন যে কবিতাকে ভালোবেসে ফেললাম , নিজেই জানি না। আমাদের রক্ষণশীল পরিবারের সব বিধান মেনে নিতে পারতাম না। কিন্তু প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করার সাহস ছিল না।লুকোনো ডায়েরীতে রাগ ,মান ,অভিমানের কথা লিখে রাখতাম। সেগুলো হয়ত কবিতা হত না.. কিন্তু আমার বড়ো আপন ছিল।

স্কুল আমার বাড়ি থেকে তিন চার মিনিটের হাঁটাপথ ছিল। কিন্তু মেয়ে একা বেরোবে না… এই ধারণা থেকে ,কাজের মাসি আমায় স্কুলে দিয়ে আসত আবার নিয়ে আসত। খুব রাগ হত আমার… রাগের চোটে কাজের মাসি সাত হাত পেছনে পড়ে থাকত , আমি হনহন করে আগে হাঁটতাম।বন্ধুরা হাসাহাসি করতো… আমার মোটেও ভালো লাগত না। ছোটবেলায় তাই বোধহয় খুব ইন্ট্রোভার্ট ছিলাম।

এই করতে করতে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলাম। তখন আমি একটু মন দিয়ে পড়াশোনা করতাম। মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোল… সে এক ভয়ানক কাণ্ড!! আমি স্টার পেলাম !! বাড়িতে সবাই ভাবছিল মেয়েটা পাশ করলে হয়… কিন্তু স্টার দেখে, বাবা মা তো হতবাক ! কী যে খুশি হয়েছিল, বলে বোঝাতে পারবো না। আমার কদর বেশ বেড়ে গেল ! বেথুনেই সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হলাম, ফার্স্ট ডিভিশনে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলাম।
মা বাবার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল তারা আমার বিয়ে নিয়ে বেশ ভাবছে। আমি তো বেঁকে বসলাম, এখন বিয়ে নয়… আমি পড়ব।

যাইহোক বেথুন কলেজে ম্যাথস অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম। খুব আনন্দে কেটেছে আমার কলেজের দিনগুলো। তখন খুব খোলামেলা প্রকৃতির হয়ে গেছিলাম। না প্রেমট্রেম আর করা হয় নি, কারণ ততোদিনে, আমার মাসির দূর সম্পর্কের আত্মীয়র সংগে আমার বিয়ে ফাইনাল। আমার গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হলেই বিয়ে হবে… এমন কথা হয়ে আছে।

একুশ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেল। জামসেদপুরে শ্বশুরবাড়ি… পতিদেব আই আই টি কানপুরের ইঞ্জিনিয়র। চাকরীসূত্রে ভাইজাগে সেটেলড। কলকাতার পাট চুকিয়ে চলে এলাম ভাইজাগ।মুখার্জ্জী সাহেব মানুষটি খুবই ভালো। খুব কেয়ারিং, চোখ বুজে নির্ভর করা যায়। তবে বন্ধু কম, গার্জেন বেশি। যখন বিয়ে হয়, আমার ম্যাচিওরিটি প্রায় ছিলই না। সংসারে মোটে মন নেই , সব কাজ ভুলে যেতাম। তিনি মাঝেমাঝেই বকা দিতেন। কলকাতার বাইরে নতুন জায়গায় মন লাগত না। মনে হত বেড়াতে এসেছি , আবার ফিরে যাব। তিন বছর পর আমার একমাত্র সন্তান জিত জন্মায়। আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি। ছেলের এ্যাকাডেমিক সাফল্যগুলো , খুব আনন্দ দিত আমায়। সংসারের ফাঁকে ছেলে কে ঘিরেই আমার দিন কাটত। আজ দশবছর হল সে বিদেশে। বিয়ে হয়ে গেছে খুব ভালো আছে তারা। দু একবছর অন্তর অন্তর আমরা ওদের সংগে কিছুদিন কাটিয়ে আসি।

এখন কবিতা কে ভালো করে আঁকড়ে ধরেছি। ফেসবুকে লেখালেখি করে সময় কেটে যায়। জীবনের অনেক অপূর্ণ ইচ্ছে , এখন ফেসবুকের দৌলতে পুরো করি। কবিতা ছাড়াও অল্পস্বল্প গদ্য লেখালেখির সাহস , ফেসবুকের বন্ধুরা দেয়। একটা নিজস্ব কবিতার বই বার করার খুব ইচ্ছে !! দেখি ভবিষ্যত কী বলে…

ভাইজাগ কে আর ছাড়তে পারি নি। জায়গা টা কে ভালোবেসে ফেলেছি , তাই এখন এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। সুখে দুখে মানুষটার হাত ধরে ,পঁয়ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবন কাটিয়ে দিলাম। তবে বড়ো বোধহয় হইনি এখনও…একথা আমার নয়, আমার ঘরের মানুষটির বক্তব্য !!

,
শ্রীলেখা মুখার্জ্জী
গ্রীনসিটি টাওয়ার
ভাডলাপুডি
বিশাখাপত্তনম
অন্ধ্রপ্রদেশ