“চশমা, বাঁধানো দাঁত আর রং করা চুলে আমি—– মিসেস তুলি চক্রবর্তী “

শিল্পী পালিতঃ আজ আত্মকথায় তুলি চক্রবর্তীর (মুখার্জি) কথা মেলে ধরা হলো —

জীবনের জল তরঙ্গ
তুলি চক্রবর্তী (মুখার্জি)

জীবনের জল তরঙ্গ কখন যে বাজতে বাজতে বেহালার করুণ সুরে চলে এসেছে তা টের পাচ্ছি নিজের কথা লিখতে গিয়ে।জন্ম, বড় হওয়া এবং যথেচ্ছ দুষ্টুমি সবটাই এক অজ গ্রামে।মেদিনীপুর জেলার (তখন ভাগ হয় নি) খড়্গপুর শহর থেকে অনেক ভিতরে আমার গ্রাম, ‘সোনামুখী’। হিজলি স্টেশন লাগোয়া। বিজলি বাতি ছিল না। ধূ ধূ মাঠ আর ধানের ক্ষেত আর অজস্র গাছপালা।

হিজলি স্টেশনের উল্টৈদিকেই খড়্গপুর আই আই টি। ব্রিটিশ স্থাপত্যের বাড়ি আর সেভাবেই রক্ষণাবেক্ষণ চলছে আজও। স্কুল থেকে ফিরে রেললাইনের উপর দিয়ে হাঁটতাম দু-দিকে ডানার মতো ছড়িয়ে দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে সূর্য ডুবলেই রেললাইনের দু পাশের ল্যাম্পপোষ্টে লাল বাল্ব জ্বলে উঠলেই ঘাড় উঁচিয়ে হাঁ করে গিলে নিতে নিতে আলো আঁধারিতে এক ছুট্টে হাঁফাতে হাঁফাতে বাড়ি। অন্ধকার গাঢ় হলেই আমাদের ঘরে জ্বালানো হতো হ্যারিকেন বা লন্ঠন। লন্ঠনকে বিন্দু করে আমরা ভাইবোনেরা গোল হয়ে বসে পড়তাম। চিমনি কালিতে ঝাপসা হবার আগেই ঘুমে ঢলে পড়তাম সবাই।

এভাবেই গড়িয়ে গড়িয়ে মাধ্যমিক, তারপর বাণিজ্য বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক। কো-এড স্কুল থেকেই বয়েজ কলেজ। তখন মেয়েরা খুব কমই কমার্স বা বাণিজ্য নিয়ে পড়তো। আই আই টি র নিজস্ব স্কুলে পড়াশোনা করেছি বলেই দুষ্টুমিটাও খুব পলিশড্ ছিল। যে দুষ্টু মাপটা ডোবা ছিল তা জেলার সদরের কলেজে এসে বিশাল জলাশয়ে পরিণত হলো। হাতেখড়ি কলেজ রাজনীতির। পরিবেশ এবং পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুকরণ করলো যা নিয়ে বাড়িতে কোনও দিন সমস্যা হয় নি। হারা সিটে দাঁড়িয়ে জিতে বেরিয়ে এলাম অনেকের চক্ষুশূল হয়ে। উচ্চ মাধ্যমিকের পর ছুটিতে এবং কলেজের ছুটির দিনে আমি আই আই টি’র একটা ডিপার্টমেন্টে প্রোজেক্টে কাজ করতাম। টাকাও পেতাম। পড়া আর প্রোজেক্টের কাজ একসাথে চলছিল বেশ। হিসাবশাস্ত্রে সাম্মানিক হয়ে ভর্তি হলাম ইউনিভার্সিটিতে। চারমাস ক্লাস এবং ইতি পড়ে বিয়ে হয়ে। চাকরি করবো এই শর্তে বিয়ে তে রাজি হয়েছিলাম।

বিয়ে….. সেটাও কাগুজে। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের সাথে। চেনা পরিচিত এবং বন্ধুদের ছেড়ে চোখ বন্ধ করে কুয়োয় ঝাঁপ। বাইশ বছর হাঁকপাঁক করতে করতে কখন যে মিঠে জলে ভরে গেল কুয়ো আর আমাকে ঠেলে বের করে দিল সাগরে….. আমি আমার মতো করে সাঁতরানো শুরু করলাম অক্ষরের সাথে।
পুরোনো অভ্যাসের বিরতির জং ঝালাই করি রোজ একটু একটু করে। পালিশ করা হয়ে ওঠে নি আজও….

মায়ের বকুনি নেই, সব দুষ্টুমিতেই মুচকি হেসে সায় দেওয়া বাবা নেই,বন্ধুদের সাথে সাইকেল রেস নেই, খুঁটি উপরে দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে যাওয়া পোষা গরু নিয়ে চিন্তা নেই, সকাল থেকে সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যায় ফিরে আসা মুর্গীটা না ফেরায় কেঁদে ভাসানো সন্ধ্যা নেই….. নেই এর তালিকা বড় থেকে আরো বড় হচ্ছে দিন দিন….

শহরের বহুতলের উপরে বসে আকাশ দেখি, পাখিদের ওড়া দেখি। এখানে প্যাকেটের দুধ আর মুরগীর রক্তাক্ত মাংস আসে দ্বিধাহীন ভাবে।

দুপুর আমার নিজস্ব দুপুর। দুপুরের বুকে মুখ ডুবিয়ে লিখতে লিখতে আয়নায় নিজেকে দেখি। চশমা, বাঁধানো দাঁত আর রং করা চুলে আমি…. মিসেস তুলি চক্রবর্তী, প্রিভিলেজড্।

ব্যবহার করি অত্যাধুনিক আরামদায়ক সব উপকরণ অথচ শহর কোথাও নেই…..