” নানান ঘাত-প্রতিঘাতের লড়াইয়ের মধ্যেও হতে চেয়েছি ছেলেমেয়ের বন্ধু”

শিল্পী পালিতঃকলকাতা বৈষ্ণবঘাটা পাটুলি টাউনশীপ থেকে নিজের এই আত্মকথা লিখলেন শ্রীময়ী গুহ–

#ছোট্ট মেয়েটা স্কুটারে বাপি আর মায়ের মাঝখান থেকে নেমেই কেমন হতভম্ব, এক পায়ে ঠাণ্ডা লাগছে কেন,…. নীচু হয়ে ঘুম চোখ কচলে দ্যাখে নতুন কেনা সাদা ফুল ওলা চটিটা নেই…..

অন্য পায়েরটা আছে অবশ্য,ততক্ষণে মাথার চাইনিজ কাট চুল থেকে টুপ করে মাটিতেই পড়ে গেছে সাদা সাদা ফুলেল হেয়ার ব্যাণ্ড! পরনের দুধ সাদা ডান্সিং ফ্রকের ঝালর তুলে চোখ মুখতে গিয়েই ধরা পড়ে যায় মায়ের কাছে।
কী করছ মাম? কাজল ধ্যাবড়ানো ছলছলে বছর চারেকের চোখে তখন ভয় ভয় আর ভয় ছুটছে হু হু করে…..
নতুন চটিটা….
যাও খুঁজে আনো,… কতোবার বলেছি স্কুটারে ঘুমোবে না… কথা শোনা তো তোমার ধাতেই নেই….

মেয়ে ডুকরে ওঠে,… মা কে বোঝানোই যায় না বাপির পিঠে মুখটা রেখে স্কুটারের দুরন্ত হাওয়া খেতে খেতে নিজের পেটের কাছে মায়ের শক্ত করে জড়িয়ে রাখা হাতটার ভরসায় এই ঘুম যে বড্ড আদরের!মা কী কিছুই বোঝে না ! খালি বকে! কিন্তু সাদা নতুন একপাটি চটি সাধের চটি কোথায় খোঁজে এখন মেয়ে! রাত হয়ে গেছে, রাস্তা অন্ধকার,.. এখন তো বাড়িতেই দাঁড়িয়ে… কোন দিক থেকে যে খোঁজা শুরু করে,.. কোন রাস্তায়, কেমন করে, এসব ভেবেই হয়রান মেয়ের কান্না চলে যায় আবার ছোট্ট বুকপাঁজরের ঘরে…..
মা রাস্তা চিনি না যে! এবার কোলে তুলে নেন মা ! একটু হেসে বলেন…

পিছনের রাস্তা নাই বা চিনলে মামমাম, সামনের টা চিনো কেমন, আর এমন করে আমার কথা না শুনে যখন তখন ঘুমিয়ে পড়ে কোনকিছু হারিও না যেন,… যাতে তা খোঁজার রাস্তাটাই হারিয়ে যায়!

বাপি ততক্ষণে স্কুটার গ্যারাজে ঢোকাতে গিয়েই থমকে দাঁড়িয়েছেন… এই দ্যাখ মাম, কুকুর বাচ্চাদের দেখে যা…. আয়… এক ছুট্টে বুকে তুলে নেয় ছোট্ট মেয়ে আরোও ছোট্ট কাদা মাখা কুকুরছানাদের…. মা শিগ্গির চলো, ওপরে গিয়ে দুধ নিয়ে আসি ওদের খিদে পেয়েছে যে….

ইট নিয়ে বস্তা দিয়ে একগাদা সারি সারি ঘর আর নারকেলের মালায় করে দুধ চুকচুক খায় ছানারা, চোখ ফোটে কুটকুট করে, আর বাড়ে, বেড়ে ওঠে, আবার ছানা হয়, তারাও বড় হয়,…ছুটির দিন বাপি ডাকে-
আয় তো মাম, টিউবওয়েলে চাপ দে, স্নান করাই সবকটাকে…

ব্যস আর যায় কোথায়, সব লেজ টেজ শুদ্ধ ভেজা, ভৌ ভৌ ভ্যাক ভ্যাক গড়াগড়ি মা বেটা বেটি কালো সাদা বিস্কিট রঙ ঘিয়ে ধূসর সব সব একসাথেই পরিস্কার!
সংসার…হ্যাঁ এদের নিয়ে, মানি প্ল্যান্টের গাছ, আগান বাগান জবা গোলাপ টগর জুঁই মাটি খুঁড়ে দেওয়া, মায়ের পুজো, রান্না, অফিস, সেলাই, উলবোনা, মায়ের রাতজাগা পড়াশোনা আর কঠিন শীতল অথচ গভীর স্নেহের শাসনে ভরা সবকিছুই নিয়ে, পাখপাখালির দলবল, তাদের দানা দেওয়া, অ্যাকোয়ারিয়ামের রঙিন মাছেদের ব্যস্ততা, রেকর্ড প্লেয়ারে মান্না দে দেবব্রত বিশ্বাস সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, বারান্দায় মাধবীলতা,…. সমস্তটাকেই জড়িয়ে ধরে বিশাল সংসার, তারমধ্যেই ল্যাব্রেটর জার্মান শেপার্ড আর ডোবার ম্যান ও আমাদের বাড়ির সদস্য!
ড্রাইভার কাকু, সবসময়ের কাজের মাসিদের, আপনি বলে সম্বোধন মায়ের শেখানো।

(বাপি IOC DGM Mahasamar Raye
মা. IOC GM Dipti Raye) আর তারপর একদিন দিদিমার বাড়িতে তখন মেয়েটা সবে স্কুল থেকে ফিরেছে , দিদা নীচে একটা কাচের গাড়ি এসে থামল…… আহারে কার কোল খালি হইসে কে জানে….. কী গো দিদা! কীসের গাড়ি ওটা!
অরে কেউ চইলা গ্যালো রে!

বাপি মা কেমন আছে আজ?
বাপির চোখ টকটকে জবা ফুলের মতো লাল……
ও বাপি কাল যে বললে মাকে নিয়ে আসবে! ছোট্ট মেয়ে হাঁ করে তাকিয়ে বাপির দিকে! এনেছি তো, নীচে যাও, দ্যাখো তোমার মা কে…… চারতলার সিঁড়ি কত কত আর কত….. দুদ্দাড় করে নামছে ছোট্ট মেয়ে….
মা টা তার বড্ড অসুস্থ ছিলেন কদিন ধরেই!
দরজার আড়াল থেকে দেখত মেয়ে ডাক্তার জ্যেঠু মা কে ইনজেকশন দিতেন! নাহ ভয় টয় নেই দস্যি মেয়ের কিন্তু চিন্তা…. মায়ের তো ব্যথা লাগছে! হলুদ হয়ে যাচ্ছিলেন মায়ের মাখনরঙা অপূর্ব ব্যক্তিত্বময়ী রূপ!

বুক চিনচিন করে মেয়ের! মা কেমন ফ্যাকাশে !কই আর তো উল বোনেন না! আর তো বকেন না! আর তো বাপির স্কুটারে উল বুনতে বুনতেই অফিসেও যান না!
মা দীপ্তি রায় রাত জেগে সংস্কৃতে MA করছেন….. মেয়ে ঘুম ভেঙ্গে দ্যাখে মা পড়ছেন….
মা তোমার কী কাল স্কুল আছে? তুমি কী আমার মতো স্কুলে ভর্তি হবে? কেন রে? (হেসে ওঠেন মা)
তুমি এখন হাতের লেখা করছ মা? এত্তো মোটা বই পড়ছ?
হ্যাঁ মাম… এটাই তো সারাজীবন সাথে থাকে… তুমিও পড়বে কেমন… সারাজীবন…..
তখন বোঝেনি বাচ্চা মেয়ে, কী এত পড়ে মা…
অফিস করে, এত এত সেলাই উল ক্রুশ বুনেও, সেলাই শেখানোর ক্লাস করেও, ভোরে উঠে একঢাল কালো কোঁকরানো চুল ভিজিয়ে স্নান সেরে লাল পাড় শাড়ি পরে পুজো সেরে,…
মামমাম ওঠো ভোর হয়ে গেল যে…. বলেও কীভাবে এত রাতে পড়েন!

মা!নাচ গান আঁকা সাঁতার পড়াশোনা শুধু স্কুলের নয়, প্রচণ্ড রকমের বই পড়ার নেশায় মেয়েকে ডুবিয়ে দিয়ে নিজেই কোথায় চলে গেলেন……”
ঘুমিয়ে ছিলাম মায়ের কোলে কখন যে মা গেল চলে
সবাই বলে ঐ আকাশে লুকিয়ে আছে খুঁজে নাও
ও তোতা পাখি রে! ”
সেই দিন,…. সেই যে দিদিমা বললেন, ওটা স্বর্গরথ … কেউ চলে গেলেন….
হ্যাঁ নীচে গিয়ে দেখি মা টি আমার লাল সিঁদুরে লালচে গোলাপি হয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে….
মা ওঠো, ওঠো না!
উঠলেন না তো!
কোলে করে নিয়ে গেলেন মাসি আদর করে কাঁদতে কাঁদতে!
বাপি এসে বললেন…..
. মামমাম এতো কাঁদলে যে মা যেতে পারছেন না,…. তাঁকে শান্তিতে যেতে দাও!
কেন? আমি কাঁদলে মায়ের কেন শান্তিতে যাওয়া হবে না কোথায় যাবে মা?
বলিনি! চুপ করে গেলাম! বুঝলাম না কিচ্ছু!
চুপ করতে শিখলাম,… কিন্তু মৃত্যু কী শিখি নি তখনও…..
আত্মীয়রা বললেন-
তুমি কাঁদবে না, তাহলে বাপিও যে কাঁদবে! তাই তো!

কান্না গিলতেও শিখে নিলাম, কিন্তু চলে যাওয়া কী বুঝলাম না!শশুধু স্কুটারে একা বাপিকে ফিরতে দেখে পাগল পাগল লাগত!আর একবার মাত্র একবারও কী দেখতে পাব না মা কে!এ কেমন নিয়ম!কীইইইই করেছি আমি যে মা রাগ করল এত!

বড্ড ছোট যে তখন,… মেয়েই হইনি শারীরিক ভাবে… কিন্তু মা হয়ে উঠতে শিখলাম আমার বাপিটার…… বাপির সাথেই খুনসুটি, বাপির চোখকেই ভয়,…বাপির জন্যই ভাত মেখে বসে থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়া, আবার বাপির শাসনেই সূর্য ওঠার আগেই উঠে সাইকেলে লেকে সাঁতার কাটতে যাওয়া।রাতের গভীরে অন্ধকারে একলা ছাতে দোলনায় বসে তারা দেখতে দেখতেই কথা বলতে শেখা…. মা জানোতো আজ স্কুলে এটা হয়েছে…মা জানোতো আজও বাপি বকেছে…মা জানোতো আজ আমার পা ভেঙেছে…মা জানোতো আজ আমার কেটে গেছে কোথাও, রক্তও অনেক, কিন্তু ব্যথা নেই…. মা জানোতো, বাপি বলেছে আমি বড় হয়েছি আজ,

মা জানোতো এমনভাবে বড় হওয়াটা যেন কেমন! অদ্ভূত!মা জানোতো সবার মা যান স্কুলে পরীক্ষার পর, তুমি আসোনা! মা জানোতো তোমাকে আর একবার শুধু একটিবার দেখব! এসো একবার মা! শুনছ শুনছ, তুমি মা?

ভোরের চিকচিক আলো, পাশের ঝিলে মেছুয়াদের মাছ ধরার বিশাল জাল ফেলার ছপাৎ শব্দ, ঘুম ভাঙালো একরত্তি মেয়ের….. দোলনায় মাথা রেখেই কখন যেন তারাদের মধ্যে মা তারাটিকে হারিয়ে ফেলেছে সে…..
আবৃত্তিটা কী যেন মা… তুমি বলতে শিখিয়েছিলে…!
“মা গো হারিয়ে গেছি আমি!”
আর তারপর তো চলা চলা আর চলা…..

বন্ধুদের সাথে মারপিট, দস্যি মেয়ের স্কুটার নিয়ে হুটোপুটি, বাপির সাথেই দাবা লুডো ক্যারম ব্যাডমিন্টন আর পাহাড়ে পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া!
বাড়ছে মেয়ে বাড়ছে তার বাপির প্রতি অসম্ভব মাতৃত্ববোধ! দুরন্ত মেয়ে কিন্তু ভীষণ ঠোঁটকাটা স্পষ্টবাদী কিন্তু অসম্ভব নরম! শক্তি আর সত্যের পুজারী বাপি আর মায়ের ই মতোন! গাছে চড়া, পাঁচিলে ওঠা, সাইকেল নিয়ে টো টো করে বেড়ানো হাত পা ভাঙা তো জলভাত!বন্ধুদের কোনও জেন্ডার হয় না বাপির কাছ থেকেই শেখা……

স্কুল – ইউনাইটেড মিশনারী গার্লস হাই স্কুল! পিওর সাইন্সের স্টুডেন্ট ছিল মেয়েটি, সাঁতারে আঁকায় খেলাধুলায় নাচে মন্দ ছিল না বেশ কিছু পুরস্কার টুরস্কারও পেয়েছে, আর ডায়েরির পাতা ভর্তির করত এঁকে আর ছোটখাটো যা মনে আসে লিখে লিখে!পড়াশোনায় উৎসাহ তো বরাবরের …..কিন্তু মাথা গরম হলেই মেয়ে বসে যেত অঙ্ক নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা!অঙ্ক আর পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়ে থাকত একলা অথবা ছাতের ঘরে ইজেল আর রঙ তুলিতে বিভোর মেয়ে….
যখন নামত তখন অন্যরকম… যে দমবন্ধ ঝড়ের পূর্বাভাস ছিল কয়েক ঘন্টা আগে মেয়ের চোখে মুখে, তা একদম সূর্যমুখীর আলো এখন….. এই তো আমার মামমামটা! এই তো বেশ শিখে গেছিস রাগ শুষে ব্লটিং পেপার হতে! বাপির মুখে এক ঝলক উদার আলো!এমনভাবেই নিজেকেই জয় করতে হয় রে মাম হারিয়ে দিতে হয় নিজেকেই।

দুরন্ত প্রেম করে বিয়ে IOC র Gas distributor কে! তখন যোগমায়া দেবী কলেজ, তখন হাজরা মোড়ের রাজনীতির মিছিলে মুঠি মেলানো তখন কারণে অকারণে কলেজের সিঁড়িতে আশুতোষের ছেলেদের সাথে ফ্যা ফ্যা করে মারপিট, তখন ক্যান্টিনে চায়ের কাপ আর প্রথম ধোঁয়ায়… খক খক খক ! ধ্যাত এক্কেবারে বাজে কী করে যে খাস এসব!তখন কফি হাউসের টেবিল চাপড়ে যা তা খিল্লি ওড়ানো তখন বখাটে নামটার প্রতি দুরন্ত নিষিদ্ধ আকর্ষণ!
কিন্তু প্রেমটা এল এবং জোরদার… তাও আবার সেই আন্দামানে গিয়ে হল পরিচয়!

সেই নিয়ে তুমুল ঝড়, কারণ এটা নীতিবিরুদ্ধ….. আরে নাহ বাপি বা তার মেয়েটি বা হবু বরটির কেউ ই জাত পাতের তোয়াক্কা করে না,… এল ঝড় অন্যদিক থেকে! হয় বাপির চাকরি থাকবে নয়তো যাবে ছেলেটির ব্যবসা…. এমনই নিয়ম অফিসের! আর সেই প্রথম এমন বিয়ে… আর আজ অবধি , এত বছরেও এমন কাণ্ড আর একটাও হয়ও নি!তাই এই দম্পতি বেশ বিখ্যাত ঐ একটা কারণে আজও! হাঃ হাঃ হাঃ! কিন্তু মিয়া বিবি রাজি তো ক্যায়া করেগা কাজী… যাই হোক বে’ তো হল, এবং বাপির ট্রান্সফার হল… বজায় থাকল দুটোদিকই…..

পড়তে পড়তেই বিয়ে, যৌথ পরিবার, বিশাল পরিবারে, তিন জা ভাসুররা ননদ ননদাই শ্বশুর শাশুড়ি মা সব সব মিলে এক্কেবারে রোজ রোজ যেন নতুন নতুন ঘরের পিকনিক,… তাতে মন্দ মিশেলের ঘাটতি ছিল বলব না কিন্তু ভালোটাই বেশি, অফুরন্ত ভালোবাসা, নানা রকমের মানুষ, নানা রকম বোঝা পড়া আর নানা রকম রাগ অনুরাগ! অনেক গভীরে তার বন্ধন!

পুত্রের জন্মের পরেই শুরু হয় জীবন যুদ্ধ….সেটা সম্পূর্ণভাবে অন্য এক দিক জীবনের!
চল্লিশ দিনের শিশু আর বৃদ্ধ বৃদ্ধা শ্বশুর শাশুড়ি মা এবং ননদ ননদাইকে নিয়ে একটি ঘরেই আরম্ভ হয় কষ্টের জীবন। আর্থিক অবস্থার কথা আর নাই বা বললাম তখনকার। ব্যবসার ক্ষতি বা লাভ তো থাকেই আজীবন… কিন্তু বাপিটি আমার বাইরে থেকেও জানতে চেয়েছেন বহূবার… মুখ খোলাতে ব্যর্থ হয়েছেন মেয়ের,…..

আমার যুদ্ধ, আমাদের যুদ্ধ, আমাকেই লড়তে দাও বাপি,.. তুমি আছো জানি কিন্তু আমিও তো পারি তাই না! ছোট থেকেই যে স্বাধীনতা দিয়েছ যে অবাধ সাহস দিয়েছ,আজ তার গুরুদক্ষিণা দেওয়ার সময় যে গো,
আমাকে দুর্বল করে দিও না বাপি, আমাকে একলা যুদ্ধ করতে দাও ছোটবেলার মতোই।

বাপি মেনে নিয়েছিলেন এই তেজি জেদী একবগ্গা মেয়ের ভিতরের আগুনকে, কারণ এই আগুন তো তিনিই জ্বালিয়ে দিয়েছেন ছোট্ট থেকেই আত্মজার মধ্যে….
এরপর নানান ওঠা পড়ার মধ্যেই কন্যার জন্ম, আমার আবার পড়াশোনা এবং আবার রামানন্দ বন্ধ্যোপাধ্যায় জ্যেঠুর কাছে আঁকা নিয়ে কাজে যোগ দেওয়া।শ্বশুরমশাইয়ের মৃত্যু, শাশুড়ি মায়ের মৃত্যু আমারই কোলে, এই মা টি ছিলেন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি,.. শাশুড়ি মা কে হারিয়ে আরোও একবার তারা দেখতে ছুটেছিলাম রাতগভীরের আকাশে….

আশ্চর্য্য না!
পরপর বছরগুলো শুধুই মৃত্যু আনল ডেকে!
আমি স্থির ধীর অচঞ্চল হয়ে আমার কর্তাটির বুক ভাঙা কান্নাগুলোকে আঁচল দিয়ে মোছাতে চাই নি,. শুধু চেয়েছি ওর কান্নাদের আমার না কান্নার মেঘলা জমাট হাসিতেই শুষে নিতে…. চেয়েছি ওকে হালকা হতে দিতে।
এরপর এল সেই দিন যেদিন বাপির শরীরের শেষ সাদা ধবধবে কাপড়টাও হাওয়ায় উড়ে গেল আর পাটকাঠিতে ধিকিধিকি আগুনটা ছুঁইয়ে দিলাম তাঁর ঠোঁটে।আমিই যে তোমার সন্তান বাপি, চিন্তা নেই, তুমি নিশ্চিন্তে যাও মায়ের কাছে তারায় তারায়, আমি ভালো থাকবোই! ঠাকুর্দাটি অপেক্ষায় ছিলেন আমার ফেরার… সব কাজ করেছ তো? হ্যাঁ! এর পরের বছর ঠাকুর্দার হিমশীতল দেহ!আমিই তো একমাত্র, যে কিনা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছি বারবারই ছোট থেকেই… অগত্যা এই মেয়েটাই তো এগিয়ে আসবে।ওম শান্তি!কাজ সমাপন হল আমার!

এখনও পড়ছি, পড়েই চলেছি একটার পর একটা কোর্স, এমনি এমনিই…
ডিগ্রির জন্য নয় পড়ার জন্যই পড়ছি,.. পরীক্ষাও দিচ্ছি…
এখনও আঁকছি এঁকেই চলেছি,.. পুরস্কার পাওয়ার জন্য নয় কারণ বুক পকেট থেকে ছোট ডেয়ারী মিল্ক দেওয়ার মানুষটা আমার বাপি আর শারীরিক ভাবে আসেন না পুরস্কারটা হাতে নিয়ে দেখতে,আঁকি আমার ভালো লাগে বলে…
এখনও মুহূর্তে বাঁচি আমি, কারণ জীবন মানেই যুদ্ধ, জীবন মানেই পাটকাঠিতে ধিকিধিকি আগুন,
জীবন মানেই রাস্তাটা খুঁজে নেওয়া, জীবন মানেই নিজেকে নিজের কাছেই হারতে না দেওয়া,… এটাই শিখেছি, তাই এই মুহুর্তটাই অমূল্য আমার কাছে,… আর যখনই ভাঙতে থাকি, ভাঙচুরের মধ্যে পড়ে প্রবল ঝড়ের দাপটে ওলোটপালট হতে থাকি খড়কুটোর মতোই আঁকড়ে ধরি হারিয়ে ফেলা না হারানো সম্পর্কদের…. দাঁড়াই আমার আয়নার সামনে ময়নাতদন্ত করি আমার অন্তরঘরের…. আসি আবার গভীর রাতের তারাদের কাছে… যাঁরা বলেছেননিজেকেই খোঁজো মামমাম, শুধু একপাটি চটি নয় দুপাটিই যত্নে রাখতে শেখো… নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হও মামমাম, কষ্ট পাওয়াটা কিছুই নয় ওটা অমূল্য সম্পদ, তুমি যদি যোগ্য হও আজ নয় কাল পাবেই তোমার মনের আলোর খোঁজ…. তর জন্যই ফিইরা আসুম ছোটমা আমার, তুই আমার ছোট বৌমা নস রে, কেবল তুই যে আমার মা,গইড়া তোলা কঠিন ভাঙনডা বড্ড সহজ! তুই গইড়া যা! বড্ড ভুগছিলেন আমার কর্মঠ উদার শাশুড়ি মা টি শেষদিকে, ক্যাথিটার টেনে খুলে দিতেন বেডসোরের দিকেই এগোচ্ছিলেন, প্যারালাইজড জীবন, মনটুকু ধুকপুক আর একমাত্র আমিই তার সবটুকু…. বড় ভালোবেসেছেন আমাকে…. আজও মনে পড়ে থুইয়া দে হকলডি, আমি সাইরা উইঠ্যা তরে সব আনাজপাতি কুইট্যা দিমু রে!

আত্মকথা কী জানি না !
তবে দু দুবার অফিস থেকে কাজের অফার ছেড়েছি কারণ পুত্র কন্যা বড্ড ছোট আর ঘরে বৃদ্ধ বৃদ্ধা শ্বশুর শাশুড়ি আমার ঠাকুর্দাও।আত্মকথা লেখার স্পর্ধা বা তেমন কিছু বলারও নেই আমার, কিন্তু সবসময়ই মনে হয় নানান ঘাত প্রতিঘাতে ওঠা পড়ার মধ্যে হাবুডুবু খাওয়ার উপক্রম হতে হতেই কিন্তু সাঁতরেছি প্রাণপণ আর এত কিছুর মধ্যেও হতে চেয়েছি ছেলে মেয়ের বন্ধু…. মা!
মনে পড়ে মা বাপি দুজনেই বলতেন-
বৃক্ষ তোমার নাম কী?
ফলেন পরিচয়তে!!

©শ্রীময়ী গুহ
I/23 baishnabghata patuli township
Kolkata 94